রেস্তোরাঁ খুললে ৫০% লাভ। খুদেদের স্কুল খুললে ৩০%। তবে ঝুঁকি অনেক কম।
আর সেই টানেই ম্যাড়মেড়ে লোহার গেটওয়ালা বাড়ি এখন ভোল বদলে মিকি মাউস, ডোনাল্ড ডাক আর টম অ্যান্ড জেরির পরিপাটি সংসার। লাল-হলুদ , সবুজ-নীল রঙে সাজানো নার্সারি স্কুলে পাড়ার কচি-কাঁচাদের সকাল থেকে ভিড়। ২-৫ বছরের পড়ুয়াদের স্কুলের নামের জোরেই এখন পাড়ার পরিচিতি।
কয়েক বছর আগেও এই ছবিটা কলকাতা শহর ও শহরতলিতে সীমাবদ্ধ ছিল। এখন খুদে পড়ুয়াদের দিকে নজর রেখে ‘প্রি-স্কুল’ ব্যবসা ছড়াচ্ছে দ্বিতীয় ও তৃতীয় স্তরের শহরেও। চাহিদা ও জোগানের ছক মেনেই ছোট শহরেও চালু হচ্ছে এ ধরনের স্কুল। ব্যবসার গন্ধে পৌঁছে যাচ্ছে নামী-দামি ব্র্যান্ডের চেন স্কুলও। মোট ব্যবসার ৩০% আপাতত ছোট শহরের দখলে।
রাজ্যের এই ছবি গোটা দেশের ‘প্রি-স্কুল’ ব্যবসারই প্রতিচ্ছবি। ভারতে এই ব্যবসার মাপ এখন প্রায় ৭ হাজার কোটি টাকা। মূল্যায়ন সংস্থা ক্রিসিল-এর রিপোর্ট অনুয়াযী ২০১৫-’১৬ সালে ব্যবসার পরিমাণ দাঁড়াবে ১৩,৩০০ কোটি। আর এতে বড় শহরের পাশাপাশি ছোট শহরের ভূমিকাও গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠবে। গোটা দেশে ২-৬ বছরের শিশুর সংখ্যা ১১ কোটির কাছাকাছি। অবশ্য এই সংখ্যার কণামাত্র এ ধরনের স্কুলে যায়।
তবে এখনও এই বাজারের সিংহভাগই অসংগঠিত। অর্থাৎ ‘আন্টি-নেক্সট ডোর’ বা বাড়ির পাশেই ঘরোয়া কায়দায় স্কুল চালানোর প্রবণতাই বেশি। সংশ্লিষ্ট মহলের মতে, এ ধরনের ব্যবসা চটজলদি শুরু করার দু’টি কারণ। প্রথমত, এ জন্য ‘অ্যাফিলিয়েশন’ বা শিক্ষা দফতরের অনুমোদন লাগে না। দ্বিতীয়ত স্কুল খোলার জন্য পুঁজির অঙ্ক বড় নয়। জি গোষ্ঠীর প্রি-স্কুল চেন কিডজি-র পূর্বাঞ্চলীয় প্রধান অবিনাশ কুন্দলিয়া জানান, সংগঠিত ক্ষেত্রে প্রাথমিক লগ্নি ৮-১০ লক্ষ টাকা। এই অঙ্কটা অবশ্য মূলত চেন স্কুলের জন্য প্রযোজ্য। কারণ সে ক্ষেত্রে ফ্র্যাঞ্চাইজি নেওয়ার খরচই প্রায় ৫ লক্ষ টাকা।
ইউরোকিডজ, কিডজি, ট্রিহাউস, ক্যাঙ্গারু কিডস-সহ ২১টি চেন স্কুল দেশে ছড়িয়ে রয়েছে। সব মিলিয়ে প্রায় ২,০০০টি স্কুল এ সব চেন-এর আওতায় রয়েছে। পড়ুয়ার সংখ্যা ২ লক্ষের বেশি। গত চার বছরে এই ব্যবসা ৩৫% হারে বেড়েছে। এবং এই বাড়বাড়ন্ত থমকে যাবে না বলে দাবি বিশেষজ্ঞদের। তা স্পষ্ট ক্রিসিল-এর রিপোর্টেও। ২০১৫-’১৬ সালে ১৩,৩০০ কোটি টাকার ব্যবসায়ে সংগঠিত ক্ষেত্র থেকে আসবে ৪৫০০ কোটি টাকা। ঊর্ধ্বমুখী এই বাজারে গড়ে ৩০% লাভ করে স্কুলগুলি। না-লাভ না-ক্ষতির জায়গায় পৌঁছে যেতে বছর খানেকের বেশি সময় লাগে না। ফলে নিত্যনতুন স্কুল খোলার পেছনে এই হিসেবের বড় ভূমিকা রয়েছে বলে মনে করছে সংশ্লিষ্ট মহল।
এ সব স্কুলের রমরমার বড় কারণ বাবা-মায়েদের সচেতনতা বৃদ্ধি। গবেষণা বলছে, শেখার ক্ষমতার ৪০% তৈরি হয় প্রথম চার বছর বয়েসে। এই ভাবনার সূত্রেই শহরের ১১.৫% বাচ্চা এ ধরনের স্কুলে যায়। ইউরো-কিড্জ ইন্টারন্যাশনাল-এর পূর্বাঞ্চলীয় কর্তা নবনীত ড্যানিয়েল অ্যালি বলেন, “তিন বছরে আশা করি সংগঠিত ক্ষেত্রের দখলে থাকবে ২৫% বাজার। বর্তমানে তা ১২%। ছোট শহরে উপস্থিতি জোরালো করতে স্কুল ফি-এর কাঠামোও বদলানো হচ্ছে।”
বর্তমানে নামী ব্র্যান্ডের প্রি-স্কুলে পড়ানোর মাসিক খরচ গড়ে দেড় থেকে পাঁচ হাজার। এই খরচ করতে এখন অনেক বাবা-মা রাজি। শহরের শ্রেণি অনুযায়ী এই ‘ফি’ নির্ধারিত হয়। সংগঠিত ও অসংগঠিত, দু’টি ক্ষেত্রেই এই হিসেব প্রযোজ্য। সংশ্লিষ্ট মহলের মতে, পাঠ্যক্রমের ক্ষেত্রেও বিশেষ কোনও ফারাক হয় না। তবে কী ভাবে পড়ানো হচ্ছে, সেটার উপরেই নির্ভর করে স্কুলের সাফল্য। ট্রিহাউস-এর চেয়ারম্যান সঞ্জয় কুলকার্নির দাবি, প্রতিযোগিতার বাজারে এগিয়ে থাকতে মানবসম্পদের উপরে জোর দিতে হবে। এ জন্য বিশ্ব মানের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ দেওয়া জরুরি। |