ভরা মরসুম। কিন্তু আবহাওয়ার মতিগতি ইলিশের অনুকূল নয়। টানা বৃষ্টির দেখা নেই। নেই পূবালি বাতাস। ফলে মাথায় হাত পড়েছে মৎস্যজীবীদের। কারণ তাঁদের এখন চিন্তা, এমন অবস্থা চলতে থাকলে কী ভাবে মহাজনের ঋণ শোধ করবেন?
দক্ষিণ ২৪ পরগনার কাকদ্বীপ মহকুমার নামখানা, সাগর, কাকদ্বীপ, পাথরপ্রতিমা—চারটি ব্লক মিলিয়ে প্রায় ২ হাজার ট্রলার ইলিশের মরসুমে মাছ ধরতে যায়। কিন্তু এ বার বিধি বাম। সমুদ্রে রুপোলি ‘শস্যের’ যথেষ্ট অভাব রয়েছে বলে মৎস্যজীবীদের বক্তব্য। ফলে চাহিদা অনুযায়ী মিলছে না ইলিশ। মৎস্যজীবীদের ফিরতে হচ্ছে প্রায় খালি হাতেই। অথচ গভীর সমুদ্রে মাছ ধরার জন্য ট্রলার পাঠাতে ট্রলার মালিকদের প্রতিবার (ট্রিপ) লক্ষাধিক টাকা খরচ হয়। তার উপর মরসুমের শুরুতে ট্রলার মেরামতি, মাছ ধরার জাল কেনা বাবদ বেশ কয়েক লক্ষ টাকা খরচ করতে হয় ট্রলার মালিকদের। এই টাকা ট্রলারের মালিকেরা মহাজনদের কাছ থেক ঋণ হিসাবে নেন। মরসুম শেষে মাছ বিক্রির টাকায় সেই ঋণ শোধ করেন তাঁরা। কিন্তু গত কয়েক বছর ধরে ইলিশের মরসুমে তেমন আশানুরূপ মাছ না মেলায় ঋণ শোধ করতে সমস্যা পড়তে হচ্ছে ট্রলার মালিকদের। আগের ঋণের টাকা বকেয়া থাকায় অনেক মহাজনই ফের ঋণ দিতে চাহিছেন না। ট্রলার মালিকদের এমন অবস্থায় সমস্যায় পড়ে গিয়েছেন মৎস্যজীবীরাও। মরসুমে তাঁরা যা রোজগার করেন তাতেও ভীষণভাবে টান পড়েছে। অবস্থা এমনই যে অনেক ট্রলার এ বার মরসুমে সমুদ্রে মাছ ধরতে যাওয়া বন্ধ করেছে। |
মৎস্যজীবীদের মতে, টানা বৃষ্টির অভাব, সেই সঙ্গে পূবালি হাওয়ার অভাবে এই অবস্থা হয়েছে। কারণ এখানকার সমুদ্রে ইলিশের ঋাঁক ঢোকে মূলত বাংলাদেশ ও মায়ানমার হয়ে। পূবালি হাওয়ার অভাব থাকায় তা হতে পারছে না। তা ছাড়া হুগলি নদীতে দূষণের কারণে এবং বিভিন্ন চর পড়ে যাওয়ায় স্রোত কমে গিয়েছে। সেটাও অন্যতম সমস্যা। সেই সঙ্গে খোকা ইলিশ ধরার উপরে যে সরকারি নিষেধাজ্ঞা রয়েছে বহু ক্ষেত্রে তা মানা হচ্ছে না। মৎস্যজীবীদের দাবি, সরকারি নিয়মানুযায়ী ৯০ মিলিমিটার আকৃতির জাল ব্যবহার করার নির্দেশ থাকলেও তা অমান্য করেই তার চেয়ে ঘন বুননের জাল ব্যবহার করা হচ্ছে। এর ফলে ছোট মাছ ধরা পড়ে যাওয়ায় তা বাড়ার সুযোগ পাচ্ছে না। সর্বোপরি সুষ্ঠু নজরদারির অভাবে বিদেশি ট্রলারের যখন তখন অনুপ্রবেশের ফলেও ইলিশের আকাল দেখা দিচ্ছে। এর বিরুদ্ধে তাঁরা একাধিকবার প্রশাসনের কাছে ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য দাবি জানালেও কোনও কাজ হয়নি বলে অভিযোগ।
প্রতি বছর ইলিশের মরসুমে গভীর সমুদ্রে যাওয়া মৎস্যজীবী বছর পঞ্চাশের ভগবান জানা বলেন, “ইলিশ ডিম পাড়ে মিঠে জলে, নদীতে ঢুকে। পরে ডিম থেকে পোনা একটু বড় হলে ফের সমুদ্রে নেমে যায়। কিন্তু সমুদ্রে নেমে যাওয়ার আগেই মিহি জাল পেতে ওই সব চারা ধরে ফেলা হচ্ছে। ফলে সমুদ্রে গিয়ে তা আর বেড়ে ওঠার সুযোগ পাচ্ছে না। এই অবস্থায় প্রশাসন কঠোর ব্যবস্থা না নিলে তেমন দিন আর বেশি দূরে নয়, যখন ইলিশ অদৃশ্য হয়ে যাবে।”
সাউথ সুন্দরবন ফিশারমেন অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি ও ট্রলারের মালিক মোজাম্মেল খান বলেন, “ইলিশ ধরার মরসুম শুরু হয় জুন মাস থেকে। চলে অগস্ট, সেপ্টেম্বর পর্যন্ত। এখনও পর্যন্ত ৭-৮ বার ট্রলার সমুদ্রে গিয়েছে। কিন্তু প্রতিবারই প্রায় খালি হাতেই ফিরতে হয়েছে। আমার মতো বহু ট্রলার মালিকই চরম আর্থিক ক্ষতির মুখে পড়েছেন।” কাকদ্বীপ মৎস্যজীবী কল্যাণ সমিতির সভাপতি বিজন মাইতির কথায়, “গত মরসুমে এই সময়ে ইলিশ উঠেছিল প্রায় ১৮ হাজার টন। এ বছর এখনও পর্যন্ত তা ১২ হাজার টনে দাঁড়িয়ে। ঘাটতি ৬ হাজার। আবহাওয়ার খামখেয়ালিপনার পাশাপাশি প্রশাসনের উপযুক্ত নজরদারির অভাব এর অন্যতম কারণ।”
ইলিশের আকালের কথা শোনা গিয়েছে মাছের আড়তগুলিতেও। ডায়মন্ড হারবারের নগেন্দ্রবাজার আড়তদার ইউনিয়নের সদস্য রাম দাসের বক্তব্য, “গত কয়েক বছর ধরেই ইলিশের তেমন জোগান নেই। এ বছর অবস্থা আরও খারাপ। এখনও পর্যন্ত ঘাটতির পরিমাণ প্রায় ৮০ শতাংশ।” |