প্রবন্ধ ২...
রাষ্ট্রপতি কোথা হইতে... ঔপনিবেশিক উত্তরাধিকার
সাম্প্রতিক রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে যে টানাপড়েন হল, তাকে কেন্দ্র করে ভারতীয় জনসমাজে কতকগুলি প্রশ্ন ঘোরাফেরা করছে। এক, রাষ্ট্রপতি পদটি যদি প্রকৃত শাসকের না হয়, তবে তাঁর নির্বাচনকে কেন্দ্র করে এত দলীয়তা কেন? দুই, ব্রিটিশ সংসদীয় কাঠামোকে আমরা কেন হুবহু নকল করব, যাতে রাষ্ট্রের প্রধান এবং সরকারের প্রধানের মধ্যে একটি ব্যবধান রচনা করা হয়? তিন, যদি রাষ্ট্রপতি প্রকৃত শাসক না হন, তবে আদৌ ওই পদটি রাখার কী প্রয়োজন?
এ কথা ভাবা ঠিক নয় যে, ব্রিটিশ সংসদীয় ব্যবস্থাকে আমরা প্রশ্নহীন ভাবে পছন্দ করেছি। বস্তুত আমাদের সংবিধান প্রণেতাদের কাছে এই মডেলটি গ্রহণ করা ভিন্ন উপায় ছিল না। ভারতের সাংবিধানিক অবস্থানটি একটি দীর্ঘ ঐতিহাসিক আইনগত বিবর্তনের ফল। এই বিবর্তন অন্য কোনও রাষ্ট্রে এতটা সাফল্যের সঙ্গে হয়নি। খোদ ব্রিটেনেও নয়। আমাদের সৌভাগ্য এই যে, স্বাধীনতা যুদ্ধের অগ্রভাগে শুধুমাত্র উগ্র দেশপ্রেমিকরাই ছিলেন না, ছিলেন পাশ্চাত্য আইন ও রাজনৈতিক দর্শনে পণ্ডিতরাও।
১৮৫৭ সালে কোম্পানি শাসন শেষ হওয়ার পর যখন সরাসরি ব্রিটিশ শাসনাধীনে এল ভারত, তখন থেকেই এই সাংবিধানিক বিবর্তনের শুরু। ১৮৫৮ সালের প্রথম ভারত শাসন আইন এ দেশকে ব্রিটিশ শাসনাধীন একটি এককেন্দ্রিক রাষ্ট্রে পরিণত করেছিল। গভর্নর জেনারেলকে অমিত শক্তিধারী করা হয়। ব্রিটিশ শাসনাধীন যাবতীয় আঞ্চলিক প্রশাসনকে তাঁর অধীনে নিয়ে আসা হয়। গভর্নর জেনারেল দায়বদ্ধ ছিলেন শুধুমাত্র ব্রিটেনের ভারত বিষয়ক সচিবের কাছে। এর পর ১৮৬১ ও ১৮৯২-এর ভারতীয় কাউন্সিলস আইন, ১৯০৯ সালের কাউন্সিলস আইন যা মর্লে-মিন্টো রিফর্মস নামে খ্যাত, মন্টেগু-চেমসফোর্থ-এর রিপোর্ট-ভিত্তিক ১৯১৯-এর ভারত শাসন আইন এবং পুনরায় ১৯০৫-এর ভারত শাসন আইন আমাদের সাংবিধানিক বিবর্তনের এক-একটি অধ্যায়। ব্রিটেন একটি এককেন্দ্রিক রাষ্ট্র। কিন্তু ভারত কেন্দ্র ও রাজ্যে বিভাজিত একটি যুক্তরাষ্ট্র। এই যুক্তরাষ্ট্র ১৯৫০ সালে সহসা আবির্ভূত হয়নি। ১৮৫৮-র কেন্দ্রীভূত আইন ১৯১৯ ও ১৯৩৫-এ সংশোধিত হয়েছিল। ১৯১৯-এর আইনে প্রথম কেন্দ্রীয় ও প্রভিন্সিয়াল তালিকার বিষয়টি নথিভুক্ত হয়। ১৯৩৫-এ তিনটি তালিকা অর্থাৎ ফেডারেল বা কেন্দ্রীয়, প্রভিন্সিয়াল এবং যুগ্ম-তালিকার ধারণাটি গৃহীত হয়। ১৯৩৭-এ দেশ জুড়ে প্রভিন্সিয়াল আইনসভাগুলিতে নির্বাচনও হয়। এই আইনসভাগুলির সদস্যরাই পরবর্তী কালে গণপরিষদের ২৯২জন সদস্য নির্বাচন করেন। গণপরিষদই স্বাধীন দেশের সংবিধানের জন্মদাতা।
আমরা দেশের স্বাধীনতার রাজনৈতিক আতিশয্যের দিকটিকে অতি গুরুত্ব দিই। আইনগত বিবর্তনটিকে পণ্ডিতের তাত্ত্বিক কচকচি হিসেবে পাত্তাই দিই না। অথচ আজকের ভারতীয় রাষ্ট্রপতি কেন শুধুই প্রজাতন্ত্রের প্রতীক বা নিছকই রাষ্ট্রপ্রধান, প্রকৃত শাসক নন, তা অনুধাবন করতে গেলে ওই বিবর্তনের প্রসঙ্গটিকে টেনে আনতেই হবে। ভারত শাসন আইন (১৯৩৫) আমাদের ‘নেটিভ’ আইন প্রণয়নের অভিজ্ঞতাকে সমৃদ্ধ করলেও বাস্তব রাজনীতির প্রেক্ষিতে ব্যর্থ হয়। ১৯১৯ ও ১৯৩৫-এর আইন প্রাদেশিক স্তরে প্রতিনিধিত্বের অভ্যাস সৃষ্টি করলেও কেন্দ্রে গভর্নর জেনারেল ও তাঁর প্রতিনিধি হিসেবে প্রদেশে গভর্নরদের ক্ষমতা অসীম ছিল। গভর্নর জেনারেল ছিলেন এ দেশে ব্রিটিশ সাংবিধানিক রাজতন্ত্রের প্রতীক। আইনসভা প্রণীত যাবতীয় আইন বাতিল এবং রাজতন্ত্রের দ্বারা ভেটো প্রদান করার ক্ষমতা অক্ষুণ্ণ ছিল। এরই ফল ৩ জুন পরিকল্পনা, যা মাউন্টব্যাটেন প্রকল্প নামে পরিচিত। অর্থাৎ দেশভাগ।
১৯৪৭-এর ৩ জুনের পরিকল্পনার উপর ভিত্তি করেই ১৮ জুলাই ব্রিটেনে পাশ হল ভারতীয় স্বাধীনতা আইন (ইন্ডিয়ান ইন্ডিপেনডেন্স অ্যাক্ট)। ওই আইন মাফিক ভারতকে দু’ভাগে বিভক্ত করে ১৪ অগস্ট ‘পাকিস্তান’ এবং ১৫ অগস্ট ‘ইন্ডিয়া’ নামক দুটি স্বায়ত্তশাসিত সত্তা বা ‘ডমিনিয়ন’-এর জন্ম দেওয়া হল। সমস্ত আইন প্রণয়নের ক্ষমতা অর্পিত হল গণপরিষদের উপর। গণপরিষদই কার্যত স্বাধীন ভারতের প্রথম সার্বভৌম আইনসভা।
দু’টি দেশেই রয়ে গেলেন গভর্নর জেনারেল। স্বাধীনতা আইনে বলা হল যে, যত দিন না দু’টি দেশে নতুন সংবিধান-নির্ভর শাসনব্যবস্থা কায়েম হয়, গভর্নর জেনারেল থাকবেন রাষ্ট্রের নিয়মতান্ত্রিক প্রধান হিসেবে। আইন প্রণয়ন, বাতিল বা প্রকৃত শাসনতান্ত্রিক ক্ষমতা কিছুই তাঁর থাকবে না। ভারতে ১৯৪৮-এর ২১ জুন পর্যন্ত রয়ে গেলেন ব্রিটিশ রাজপরিবারের আত্মীয় এবং নেহরুর সুহৃদ লর্ড মাউন্টব্যাটেন। ২১ জুন থেকে ২৬ জানুয়ারি, ১৯৫০ ওই পদে ছিলেন চক্রবর্তী রাজাগোপালাচারী। এই পদটিই রূপান্তরিত হয়ে আমাদের সংবিধানে রাষ্ট্রপতির পদ হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে। ব্রিটিশ প্রণীত স্বাধীনতা আইন মোতাবেক সৃষ্ট সার্বভৌম গণপরিষদ ও স্বাধীন ভারতের তৎকালীন নেতৃবৃন্দের পক্ষে ওই পদটিকে নিছক রাষ্ট্রপ্রধান হিসেবে গ্রহণ করাই ছিল যুক্তিসম্মত সিদ্ধান্ত।
তাৎপর্যপূর্ণ ভাবে পাকিস্তানের প্রথম গভর্নর জেনারেল হলেন মহম্মদ আলি জিন্না। প্রধানমন্ত্রী নবাবজাদা লিয়াকত আলি খান। পাকিস্তান ইসলামিক প্রজাতন্ত্রের সংবিধান চালু করল ১৯৫৬-তে। ১৯৫৮-তেই ওই সংবিধান বাতিল হল। ১৯৫৮-র ৭ অক্টোবর রাষ্ট্রপতি ইস্কান্দর মির্জা প্রধানমন্ত্রী পদের বিলোপ ঘটান। সেনানায়ক আয়ুব খান’কে দেন অমিত ক্ষমতা। কুড়ি দিনের মাথায় আয়ুব খান মির্জাকে সরিয়ে রাষ্ট্রপ্রধান হন। এর পর ১৯৬২-তে আবার সংবিধান প্রণীত হলেও প্রধানমন্ত্রী পদটি ফিরে আসে ১৯৭২-এর ৭ ডিসেম্বর। নুরুল আমিন প্রধানমন্ত্রী হন। মাত্র তেরো দিনের জন্য। ২০ ডিসেম্বর আবার পদ বিলোপ। এই ভাবে ১৯৭৩ সালে পুনরায় নতুন সংবিধান ও সংসদীয় ব্যবস্থার প্রতিষ্ঠা। জুলফিকার আলি ভুট্টো প্রধানমন্ত্রী। আবার ১৯৭৭-এ পদ বিলোপ। আরও দু’বার ১৯৮৫-তে প্রতিষ্ঠা, ১৯৮৮-তে বিলোপ। ওই বছরই প্রতিষ্ঠা, ১৯৯৯-এ বিলোপ আবার ২০০২-এ প্রতিষ্ঠা। সংসদীয়, রাষ্ট্রপতি, সেনাশাসন এবং সর্বশেষ সংযোজন ২০১২-এ, অতিসক্রিয় বিচার ব্যবস্থার দোলাচলে ত্রস্ত সে দেশের রাজনৈতিক কাঠামো।
ভারতের গণপরিষদ আইনগত ধারাবাহিকতার উপর প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল, পাকিস্তানে প্রাধান্য পেয়েছে সহসা তৈরি হওয়া রাজনৈতিক সমাজের নানাবিধ চাহিদা। এই বিষয়টি ক্রমশ অনুভূত হচ্ছে আমাদের দেশেও। যতই গভর্নর জেনারেলপ্রতিম অভিষেক হোক, সাম্প্রতিক রাষ্ট্রপতি নির্বাচন একটি বার্তা রেখে গেল। দলীয় রাজনীতির বার্তা। শেষ মুহূর্তে জোট রাজনীতির ব্যধ্যবাধকতা বা বিশেষ দলীয়তার চলমানতা আপাত বোঝাপড়া তৈরি করলেও ভবিষ্যতে একই প্রহর যাপনের সম্ভাবনা না-ও হতে পারে। এমন সংকট থেকে পরিত্রাণের উপায় খোঁজা প্রয়োজন। রাষ্ট্রপতির পদটি নিয়ে নতুন করে ভাবনাচিন্তা প্রয়োজন।
বঙ্গবাসী কলেজে রাষ্ট্রবিজ্ঞানের শিক্ষক


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.