|
|
|
|
প্রবন্ধ ১... |
শিখতে পারে, কিন্তু কেন শিখবে? |
গরিব পরিবারের শিশু পড়াশোনায় কেন আগ্রহী নয়, তা বুঝতে
তাকাতে হবে
শিক্ষার সঙ্গে জীবিকার সম্পর্কের দিকে। লিখছেন
শৈবাল কর |
সম্প্রতি একটি সমস্যা বারবার আলোচনা হচ্ছে, তা হল দরিদ্র শিশুর লেখাপড়া শেখা। স্কুলের সংখ্যা বাড়ানো হয়েছে, গরিব পরিবারের ছেলেমেয়েরা স্কুলেও যাচ্ছে, কিন্তু তারা কিছু শিখছে কি? সম্প্রতি এই পাতার কয়েকটি প্রবন্ধে (‘শিখতে পারে কিন্তু শিখছে না,’ সুগত মারজিৎ, ১০ জুলাই, ‘পাঠক্রম নিয়ে অকারণ কচকচি বন্ধ হোক,’ অভিজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায় এবং স্বাতী ভট্টাচার্য, ১৯ এপ্রিল) স্কুলে শিক্ষার মান বিষয়ে সমস্যাগুলি নিয়ে কিছু বিশ্লেষণ করা হয়েছে। যে কারণগুলি উঠে এসেছে, তার মধ্যে রয়েছে স্কুলে শিক্ষকের অনুপস্থিতি, প্রাইভেট টিউশনের রমরমা, স্কুলগুলোর জীর্ণ অবস্থা, ছাত্র-ছাত্রীদের আর্থ-সামাজিক দুর্দশা। এগুলো যে বড় বড় সমস্যা, তা তো বটেই। কিন্তু প্রশ্ন রয়েই যায়। মিড-ডে মিলের ঢালাও ব্যবস্থা করার পর ছাত্রদের উপস্থিতির হার বেড়েছে, কিন্তু তাদের লিখতে-পড়তে শেখায় এত খামতি থেকে যাচ্ছে কেন? গরিব শিশুরা নিয়মিত স্কুল যায় না, অনেকেই স্কুল ছেড়ে দেয় প্রাথমিকের গণ্ডি না পেরোতেই। যে ক’দিন স্কুলে আসে তখনও যে পড়াশোনায় খুব আগ্রহ দেখায়, এমনও নয়। বহু প্রজন্ম ধরে যারা শিক্ষার সুযোগ থেকে বঞ্চিত, অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে তাদের জন্য সে সুযোগ তৈরি করা হল। অথচ কেবলই মনে হচ্ছে যে, সে সুযোগ যেন যথেষ্ট কদর পেল না। কেবল পরিকাঠামোর ত্রুটি, শিক্ষকের গাফিলতি, দারিদ্র-বঞ্চনা কি এর ব্যাখ্যা দিতে পারে? না কি, ‘শিখতে পারত কিন্তু শিখছে না’ সমস্যাটির নেপথ্যে অন্য কোনও সত্য রয়ে গিয়েছে?
এটা ঠিকই যে, ভারতের মতো দেশে, যেখানে জাত-সম্প্রদায়ের ভেদাভেদ এত বেশি, সেখানে গরিবের উন্নতির পথ একমাত্র শিক্ষা। গরিব পরিবারগুলোও যে তা বোঝেন না, এমন নয়। তাঁরাও সন্তানের শিক্ষাকে পরিবারের উন্নততর ভবিষ্যতের উপায় বলেই দেখেন। কিন্তু দেশের সরকারের কাছে শিশুদের শিক্ষা যেমন দেশের ভবিষ্যতে বিনিয়োগ, গরিব পরিবারের কাছেও তাই। সরকার যে ভাবে দেখে, কোন স্তরের শিক্ষায় কত খরচ করলে দেশ সবচেয়ে বেশি উপকৃত হবে, গরিব বাপ-মাও তা-ই করে। হয়তো অত খুঁটিয়ে হিসেব তারা করে না, কিন্তু বাজারে কোন কাজের কত চাহিদা, কী কাজ থেকে কেমন রোজগার সম্ভব, তার একটা ধারণা তাদের আছেই। তা থেকে তারা স্থির করে নেয়, কতখানি বিনিয়োগে পরিবারের লাভ হবে সবচেয়ে বেশি। শিশুকে স্কুল ছাড়িয়ে কাজ করতে পাঠানোর সিদ্ধান্ত সেই অঙ্ক থেকেই বেরিয়ে আসে। |
|
শিক্ষা থেকে জীবিকায়। প্রযুক্তি-প্রশিক্ষণ দ্রুত উন্নতির পথ দেখাতে পারে। ছবি: অনির্বাণ সেন |
বিভিন্ন আর্থ-সামাজিক সমীক্ষা দেখাচ্ছে যে, আট থেকে দশ বছর বয়সী শিশুরাই সবচেয়ে বেশি স্কুল-ছুট হচ্ছে। তার কারণ খুঁজতে কেবল স্কুল আর শিক্ষকের দিকে তাকালে চলবে না, তাকাতে হবে এই অঙ্কের হিসেবের দিকেও। বিনা-পয়সার স্কুলে সন্তানকে পাঠাতেও গরিব পরিবারের যথেষ্ট খরচ হয়, যে হেতু সেই সময়ে শিশুটি কাজ করলে কিছু টাকা হাতে আসত। তবু পরিবার শিশুকে স্কুলে পাঠাবে, যদি মনে করে যে এতে সে ভবিষ্যতে বেশি আয় করবে, পরিবারের লাভ হবে। কিন্তু যত পড়বে তত লাভ, এটা সে না-ও ভাবতে পারে। যদি মনে হয় যে, পাঁচ বছর পড়ে সন্তান যেমন রোজগার করতে পারবে, আট বছর পড়লে তার চেয়ে খুব বেশি রোজগার বাড়বে না, তা হলে বাপ-মা বাড়তি তিন বছর পড়াতে আগ্রহী হবেন না। আবার যেখানে বাপ-মা মনে করেন যে দশ বছর না পড়ালে ভাল কাজ পাওয়ার যথেষ্ট সুযোগ নেই, সেখানে যেমন করে হোক তাঁরা তত দিনই পড়াবেন।
ধরুন একটি পরিবারের কথা, যেখানে বাবা-মা রোজগার করেন মাসে চার হাজার টাকা। মেয়ে বা ছেলেকে যদি তাঁরা একেবারেই স্কুলে না পাঠান, তা হলে দিনমজুর হিসেবে মাসে দু-আড়াই হাজার টাকা রোজগার করতে পারবে সে। সেখানে সে যদি তিন-চার বছর পড়াশোনা করে, অক্ষর পরিচয় যদি থাকে, তা হলে অসংগঠিত ক্ষেত্রে নানা ধরনের কাজ পেতে পারে, যেমন ড্রাইভার, ছোটখাট কারখানার কাজ, সাফাই কর্মী, আয়া, সিকিউরি গার্ড, প্রভৃতি। তখন তার রোজগার মাসে চার-সাড়ে চার হাজার টাকা হতে পারে। যা প্রায় ৪০-৫০ শতাংশ বেশি। অষ্টম শ্রেণি অবধি পড়লে কি খুব বেশি রোজগার বাড়বে এর থেকে? তা কিন্তু নয়, কারণ মাধ্যমিক পাশ যারা করে নি, তারা এর পরবর্তী ধাপের চাকরি (যেমন সরকারি পিওন, অঙ্গনওয়াড়ি কর্মী, কুরিয়র কোম্পানি, অসংগঠিত বা বেসরকারি ক্ষেত্রে নানা কাজ) পাবে না। সরকারি চাকরি যদি পায়, তা হলে তারা মাসে ১২ হাজার টাকা মতো পেতে পারে। কিন্তু ক’জনই বা সরকারি চাকরি পায়? বেশির ভাগই থাকছে বেসরকারি ক্ষেত্রে, এবং সেখানে ক্লাস-ফাইভ পাশ আর ক্লাস-টেন পাশের রোজগারে খুব বেশি তফাত না-ও হতে পারে। বাজারে চাকরি বিষয়ে অনিশ্চয়তা এত বেশি, যে তা সিদ্ধান্ত নেওয়ার প্রক্রিয়াকে প্রভাবিত করে, এবং বাবা-মা তা-ই বেছে নেন যেটা নিরাপদ বলে তাঁরা মনে করেন। অর্থাৎ, অল্প বিনিয়োগে যত বেশি লাভ সম্ভব, তাকেই তাঁরা গুরুত্ব দিচ্ছেন। অধিক বিনিয়োগ মানে অধিক ঝুঁকি, তাই তা থেকে সরে আসছেন।
নানা দেশ থেকে প্রাপ্ত পরিসংখ্যান কিন্তু সিদ্ধান্ত নেওয়ার এমনই একটি ছবি তুলে ধরছে। দেখা যাচ্ছে দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোতে, যেখানে স্কুলে পড়াশোনার গড়পড়তা হার এখনও বেশ কম, সেখানে প্রাথমিক-পাশ কর্মীর রোজগার আর নিরক্ষরের রোজগারের মধ্যে দূরত্ব সব চাইতে বেশি। তার পর যত পড়াশোনা করবে তত রোজগার বাড়বে, কিন্তু রোজগারে লাফটা কখনওই অত বড় হবে না। উচ্চতম শিক্ষা (স্নাতকোত্তর) সম্পূর্ণ হলে অবশ্যই রোজগার বাড়বে, এবং অনেকটাই বাড়বে। দেখা যাচ্ছে, দক্ষ এবং অদক্ষ কর্মীদের রোজগারে দূরত্ব ক্রমশ বাড়ছে। তবে অত দিন পড়াশোনা চালানোর জন্য যে বিপুল বিনিয়োগ প্রয়োজন, তা খুব কম পরিবারই করতে পারে। কিন্তু আফ্রিকার কিছু দেশ, এবং মধ্য ও লাতিন আমেরিকার দেশগুলোতে দেখা যাচ্ছে যে, রোজগারে প্রথম বড় লাফ আসছে স্কুলশিক্ষা সম্পূর্ণ করলে তবেই, প্রাথমিক পাশ করে সেখানে রোজগারে খুব বেশি হেরফের হবে না, যে হেতু প্রায় সকলেই প্রাথমিক পাশ করে ফেলেছে।
পশ্চিমের দেশগুলোতে প্রায় সকলেই স্কুলের পড়া শেষ করেছে, তাই সেখানে রোজগারে বড় রকম লাফ আনতে গেলে কেবল কলেজের পড়া শেষ করলেই হবে না, কয়েকটি বিশেষ ধরনের দক্ষতা রপ্ত করতে হবে। (একটা কথা বলে রাখা দরকার। এশিয়ার নানা দেশের মধ্যেও এই ছবির অনেক রদবদল হবে। ভারতের নানা রাজ্যেও কেরল বা গোয়াতে স্কুলশিক্ষা প্রায় সকলেই সম্পূর্ণ করছে, সেখানে দশম শ্রেণি পাশ করে রোজগারে লাফ না আসাই স্বাভাবিক।)
তবে কি গরিব আরও অনেক দিন গরিব থেকে যাবে শিক্ষা সম্পর্কে তার সিদ্ধান্তের জন্য? তা না-ও হতে পারে। কেবল বছর দিয়েই শিক্ষার পরিমাপ করার দরকার নেই। বি এ পাশ-করা বেকারের চাইতে অষ্টম শ্রেণি পাশ-করা কারিগরের চাহিদা অনেক বেশি। মফস্সলে, গ্রামাঞ্চলে, কারিগরি শিক্ষাকেন্দ্র স্থাপন করার গুরুত্ব অপরিসীম। নানা অর্থনৈতিক, আর্থ-সামাজিক সমীক্ষা থেকে এই প্রস্তাব বারবার উঠে এসেছে। অথচ সরকার যে এ ব্যাপারে উদ্যোগী, এমন কোনও প্রমাণ নেই। প্রাথমিক এবং মধ্যশিক্ষার পরে কী হবে, শিক্ষার সঙ্গে জীবিকার সম্পর্ক কী, সে বিষয়ে গরিব পরিবারকে দিশা না দেখাতে পারলে, ‘শিখতে চাইছে না’ বলে অনুযোগ করে কী লাভ? ‘কিংকর্তব্যবিমূঢ়’ শব্দের সমাস কে বলতে পারল, কে পারল না, তা কি অবান্তর হয়ে যায় না?
এখানে মনে রাখতে হবে যে, সব গরিব পরিবারই একই যুক্তি মেনে একই রকম সিদ্ধান্ত নেন, তা কিন্তু নয়। অনেক পরিবার সন্তানের জন্য অনেকখানি ঝুঁকি নিতে, নিজে বাড়তি পরিশ্রম করে সন্তানের পড়াশোনায় বাড়তি বিনিয়োগ করতে রাজি। কিন্তু তাঁদের জন্য সরকার কী সুযোগ তৈরি করেছে? আমাদের দেশে মূলধনের বাজারও প্রতিযোগিতামূলক নয়। সন্তান পড়াশোনা শিখে ভবিষ্যতে রোজগার করে ধার ফেরত দেবে, এই শর্তে ব্যাঙ্ক গরিব বাপ-মাকে ঋণ দেয় না। ঋণের সম্পর্ক সব সময়েই বিশ্বাসভাজনতার অতি সংকীর্ণ গণ্ডিতে আবদ্ধ থাকে, গরিব সেখানে প্রবেশ করতেই পারে না। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে শিক্ষা ঋণের প্রধান প্রকল্প FAFSA সরকারি টাকায় চলে। ছাত্র-ছাত্রীরা চাকরি পাওয়ার পর সুদ-সমেত ঋণ শোধ দেন। এ দেশে তেমন সুযোগ কই?
স্কুলের পড়াশোনা শেষ করে যে উচ্চশিক্ষার পথ দেখতে পাচ্ছে না, আবার বাড়তি রোজগারের পথও যার নজরে আসছে না, সে কেবল পড়ার আনন্দে পড়ে যাবে, এই কি আমাদের শিক্ষানীতি? তা যদি মেনে নিতে হয়, তা হলে ‘শিখতে পারে কিন্তু কেন শিখছে না?’ এই প্রশ্ন নিয়ে আরও বহু বছর ঘুরপাক খেতে হবে। এ বার বরং প্রশ্ন করুন, ‘শিখতে পারে, কিন্তু কেন শিখবে?’ |
লেখক সেন্টার ফর স্টাডিজ ইন সোশ্যাল সায়েন্সেস-এর অর্থনীতির শিক্ষক। মতামত ব্যক্তিগত |
|
|
|
|
|