|
|
|
|
সম্পাদক সমীপেষু... |
শিক্ষকদের অবস্থা |
অর্থনীতিবিদ সুগত মারজিতের ‘পড়ছে কিন্তু কিছুই শিখছে না’ (১০-৭) শীর্ষক আলোচনার প্রেক্ষিতে জানাই, আমি নদিয়া জেলার সদর ১ নং চক্রাধীন একটি বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক। আমার বিদ্যালয়ে দু’জন শিক্ষক। এই চক্রে ওয়ান-টিচার বিদ্যালয়ও আছে। আবার পার্শ্বশিক্ষক-সহ সেভেন-টিচার বিদ্যালয়ও আছে।
বিদ্যালয়-প্রধান হিসাবে মিড ডে মিলের দায়িত্ব সামলাতে কমপক্ষে ১১ টা ৪০ বেজে যায়। যে দিন ডিম বা মাংস হয়, চুরি ঠেকাতে এক জন টিচার হেঁশেলে রাঁধুনির পাশে বসে থাকলে ভাল হয়। ক্লাসে যেতে যেতে প্রথম পিরিয়ডের সময় প্রায় পেরিয়ে যায়। দু’জন শিক্ষকের উপর চারটে ক্লাস। ক্লাসে ৫০/৬০ জন পড়ুয়া। দশটা যোগ করতে দিয়ে ধীরে ধীরে এক এক করে খাতা দেখছি। সংশোধন করছি। একটা খাতা দেখার সময় ৩ মিনিট ধরলে ৫০-৫৫টা খাতা দেখতে দশটা অঙ্ক শেখাতে আড়াই ঘণ্টা চলে যায়।
দুজন শিক্ষক ক্লাস ফোরের পড়ুয়াকে বড় বড় বাক্য রচনা লিখতে শেখাবে, ব্যাকরণ শেখাবে, না কি অ আ...? সরকারি নির্দেশ, হোমওয়ার্ক দেওয়া যাবে না। কচি শিশুদের বেত্রাঘাত, কোনও প্রকার শাসনপীড়ন চলবে না। হোমওয়ার্কের বিধ্বংসী প্রভাব থেকে পড়ুয়াদের মুক্ত করতে হবে। অথচ বাস্তবে দেখা যায়, আপনার-আমার ঘরের বেশির ভাগ পড়ুয়া শিক্ষক-শিক্ষিকার ভয়ে-ভক্তিতে বিদ্যালয়ের হোমওয়ার্ক-টুকু অমৃত মনে করে চটজলদি করে ফেলে। অন্যথায় বাবা-মা যতই বকুক, হোমওয়ার্ক ছাড়া অন্য পড়া তারা করবে না।
চৈতন্য দাশ। ধুবুলিয়া, নদিয়া
|
২ |
সুগত মারজিৎ মহাশয় বলেছেন, যে-সব স্কুলের মান খারাপ তাদের চিহ্নিত করে কারণ দর্শাতে বলা হোক। ঠিক কথা, কোনও আপত্তি নেই। কিন্তু তার আগে দেখা দরকার, সেই সব স্কুলে ছাত্র-শিক্ষক অনুপাত কত? অন্যান্য শিক্ষোপকরণ, বসার জায়গা ইত্যাদি কী আছে? এখনও পশ্চিমবঙ্গে প্রায় অর্ধেক স্কুল চলে দু’জন শিক্ষক দিয়ে। বড়জোর তিন জন। চার বা ততোধিক শিক্ষকযুক্ত স্কুলের সংখ্যা খুবই কম। এই সব স্কুলেও মিড ডে মিলের তদারকির দায়িত্ব শিক্ষকদের। আছে প্রতি মাসে নানা রকম ট্রেনিং ও মিটিং। যাতে গড়ে এক জন শিক্ষককে ৫/৭ দিন ধরে স্কুলের বাইরে থাকতে হয়। এর উপরেও আছে ভোটের কাজ, জনগণনা, নানা রকম সার্ভের কাজ। এই বোঝা সামলানো তো দশভুজার পক্ষেই সম্ভব।
প্রাইভেট কোচিং নির্ভরতা বেড়ে যাচ্ছে, কারণ, স্কুলে লেখাপড়া হয় না। দয়া করে একটু ভেবে দেখুন তো, মাধ্যমিক, উচ্চ মাধ্যমিকে অতি ভাল ফল করা ছাত্রছাত্রীদের কত জন করে প্রাইভেট টিউটর? বাড়িতে মা-বাবা শিক্ষিত, ভাল স্কুলে লেখাপড়া করা, তাও তাদের এত প্রাইভেট টিউটর নির্ভরতা কেন? |
|
হোমওয়ার্ক-এর অর্থ এই নয়, স্কুলের দায়িত্ব কমিয়ে বাড়িতে শিখে আসতে বলা। হোমওয়ার্ক-এর অর্থ স্কুলের পরে বাড়িতে গিয়েও এই সব বিষয়ে চর্চা করা, বুঝতে চেষ্টা করা। না-পারলে স্কুলে এসে বলা, আবার বুঝিয়ে দেওয়া যাবে। শিক্ষক আবার শেখাবেন। প্রাইভেট কোচিং নির্ভরতার পক্ষে নই, আদৌ সমর্থন করি না। কিন্তু শিক্ষানীতি ও সার্বিক অবস্থা ছাত্রছাত্রীদের সে পথে যেতে বাধ্য করছে এবং শিক্ষাকে বেসরকারিকরণের পথে সরকারই এগিয়ে দিচ্ছে।
মারজিৎ মহাশয় কি অবগত আছেন, এত কিছুর পরেও আজ সব শিক্ষক মাস পয়লা বেতন পান না। ডি এ বহু শতাংশ বকেয়া। পূর্ত ভবনে খোঁজ নিলে জানা যাবে, ৩০ হাজারের বেশি পেনশন কেস ওখানেই পড়ে আছে। জেলা এবং এস আই দফতর মিলিয়ে সংখ্যাটা প্রায় ৫০০০০।
কার্তিক সাহা। শিক্ষক, কলকাতা-১২
|
৩ |
৩০ বছর শিক্ষকতার অভিজ্ঞতা থেকে বলছি, শিক্ষক সংগঠনের ছত্রচ্ছায়া, বেতন ও চাকরির নিশ্চিতি, সঙ্গে সঙ্গে সমাজচিন্তার পরিবর্তন শিক্ষকদের দায়িত্বজ্ঞানহীনতার দিকে ঠেলে দিচ্ছে। প্রতিকারের জন্য শিক্ষকদের কাজের মূল্যায়নের কোনও পদ্ধতি প্রয়োগ খুবই জরুরি।
সন্তানের পড়ার জন্য অভিভাবকরা এখন আর স্কুলের উপর নির্ভর করেন না। উচ্চ মাধ্যমিকের প্রথম হওয়া ছাত্র দূরদর্শনের সাক্ষাৎকারে বলে দেয়, ‘স্কুলে বেশি দিন যাইনি, যা পড়েছি প্রাইভেট টিউটরদের কাছে।’ ভাল ছেলেমেয়ের ধারণা দাঁড়িয়েছে: যার রেজাল্ট ভাল।
পরেশকুমার নন্দ। কলকাতা-৫৪
|
৪ |
গড়বেতা ৩ নং চক্রের অধীনে প্রত্যন্ত গ্রামীণ একটি প্রাথমিক স্কুলে আমি কর্মরত। কাছেই জঙ্গলমহল সীমানা। রাজনৈতিক অস্থিরতার কথা ছেড়েই দিলাম, আমার স্কুল সংলগ্ন এবং পার্শ্ববর্তী অঞ্চলগুলিতে যেটা চোখে পড়ার তা হল, অসংখ্য দরিদ্র গ্রাম। সামাজিক ভাবে পিছিয়ে-থাকা বাড়ির ছেলেমেয়েরাই মূলত এই স্কুলগুলিতে পড়তে আসে। বেশির ভাগ পরিবারের আয় জনমজুর খেটে। গ্রামে কাজ না-থাকলে যেতে হয় দূর-দূরান্তে। বাবা-মা কাজে চলে গেলে বাড়িতে শিশুটিকে অন্য দায়িত্ব সামলাতে হয়। ছোট ভাই-বোনকে সামলানো, গরু বা ছাগল থাকলে চরাতে নিয়ে যাওয়া, বাড়ির রান্নার জোগাড়ে সারা দিন খালের জলে ছোট মাছ ধরা, শাকপালা সংগ্রহ, এমনকী এতটুকু বয়সে হাত-পুড়িয়ে রান্না পর্যন্ত! বর্ষার সময় বাবা-মায়ের সঙ্গে জমির কাজে সেও যায়। ফল: দিনের পর দিন স্কুলে অনুপস্থিত।
অভিভাবকরা ছেলেমেয়েকে লেখাপড়া শেখাতে চান না তা নয়, অনটনের সংসারে দু’মুঠো জোগাড়ের প্রয়োজন তাঁদের কাছে প্রধান। কেন্দ্রীয় শিক্ষা আইন ২০০৯-এ এই সব বাবা-মায়ের জন্য শাস্তির বিধান আছে, কিন্তু দারিদ্র মোচনের দিশা নেই। শিশু শ্রম নিরোধক আইন নীরবে কাঁদে।
চতুর্থ শ্রেণির ছেলেমেয়েরা সত্যিই প্রথম বা দ্বিতীয় শ্রেণির অঙ্ক পারে না। ‘কিছু কিছু ক্ষেত্রে নিজের নামও লিখতে পারে না’। খতিয়ে দেখলে দেখা যাবে, এই সমস্যাগুলি কিন্তু প্রধানত গ্রামীণ স্কুলগুলির। সচ্ছল বাড়ি থেকে শহুরে সরকারি স্কুলগুলিতে আসা ছাত্রছাত্রীদের কিন্তু এ সমস্যা হাতে গোনা। তা হলে এ সব কিছুর দায় একা শিক্ষকের?
মৃণাল শতপথী। ইন্দা, খড়্গপুর, পশ্চিম মেদিনীপুর |
|
|
|
|
|