আন্দোলন পর্ব শেষ। কিন্তু প্রশাসকের দায়িত্ব নেওয়ার ঠিক আগের দিন, শুক্রবার গোর্খা জনমুক্তি মোর্চার শীর্ষ নেতা বিমল গুরুঙ্গ যেন চিন্তিত! ‘গোর্খাল্যান্ড টেরিটোরিয়াল অ্যাডমিনিস্ট্রেশন’-এর মাথা (চিফ এগজিকিউটিভ) হিসেবে আজ, শনিবার দার্জিলিং ম্যালে যিনি শপথ নেবেন, তার কপালে কেন এত ভাঁজ? |
মোর্চার অন্দরের খবর, গুরুঙ্গকে এখন ‘তাড়া করেছে’ পাহাড়ের রাজনীতিতে পূর্বসূরী সুবাস ঘিসিংয়ের ‘পরিণতি’। স্থানীয় প্রশাসক হিসেবে এক সময় (৯০-এর দশক) অনেক আশা জাগিয়েও শেষ অবধি পাহাড়বাসীর মন জয় করতে পারেনি ঘিসিং নেতৃত্বাধীন ‘দার্জিলিং গোর্খা পার্বত্য পরিষদ’ (ডিজিএইচসি)। অনুন্নয়ন, দুর্নীতি, স্থানীয় উন্নয়নের প্রতিশ্রুতি রক্ষা না করার মতো একাধিক অভিযোগ উঠেছে ডিজিএইচসি-র বিরুদ্ধে। এক সময়ে ঘিসিংয়ের ঘনিষ্ঠ অনুগামী হিসেবে গুরুঙ্গ (ডিজিএইচসি আমলের তিন বারের কাউন্সিলর) নিজেও প্রত্যক্ষ করেছেন, পাহাড়ের উন্নয়নের জন্য বরাদ্দ সরকারি টাকা উদ্যোগ বা সমন্বয়ের অভাবে পড়ে থেকেছে। কখনও তা ‘নয়ছয়’ করা হয়েছে। সেই পরিস্থিতিতে আখেরে পিছিয়ে গিয়েছে পাহাড়। পিছিয়ে পড়েছে উন্নয়ন। তাই ঘিসিংকে সরিয়ে পাহাড়ে ক্ষমতা প্রতিষ্ঠার এই চূড়ান্ত ধাপে পা রেখে গুরুঙ্গ রীতিমতো ‘সতর্ক’।
মোর্চার এক কেন্দ্রীয় কমিটির নেতার কথায়, “সভাপতি মনে করছেন, ডিজিইচসি-র সময়ে উন্নয়ন আটকে গিয়েছে। নষ্ট হয়েছে পরিকাঠামো। পাহাড়ের মানুষ তা ভাল ভাবে নেননি, বলেই মোর্চা আজ জিটিএ পরিচালনার জায়গায় আসতে পেরেছে। ভোটে জয়ের পর থেকে সভাপতি দলের যার-যার সঙ্গে দেখা করেছেন, তাঁকেই সতর্ক করে দিয়েছেন, ঘিসিংয়ের জমানার ছবি পাহাড়ে ফিরুক, তা তিনি চান না।” |
তবে শুধু উন্নয়নের প্রশ্নেই নয়, মোর্চা সূত্রে জানা গিয়েছে, গুরুঙ্গের ‘মাথাব্যথা’র আর একটা বড় কারণ দলের কর্মী ‘গোর্খাল্যান্ড পার্সোনেল’ (জিএলপি)-রা। মোর্চার নানা আন্দোলনে এই হাজার পাঁচেক জিএলপি দিনরাত এক করে খেটেছেন। সেই দায়বদ্ধতার জায়গা থেকে গুরুঙ্গও জিএলপি-দের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন, পাহাড়ে ক্ষমতায় এলে পুলিশ বা নিরাপত্তা কর্মী হিসেবে তাঁদের স্থায়ী নিয়োগের চেষ্টা করবেন। কেন্দ্র বা রাজ্যের কাছে গুরুঙ্গ একাধিক বার সে আবেদন করেও রেখেছেন। কিন্তু ব্যাপারটা এখনও এগোয়নি।
দলের তরফে এ দিনই গুরুঙ্গ সর্বসম্মত ভাবে জিটিএ-র ‘চিফ এগজিকিউটিভ’ হিসেবে মনোনীত হয়েছেন। জিটিএ-সভার চেয়ারম্যান হিসেবে মনোনীত হয়েছে প্রদীপ প্রধানের নাম। দলের শীর্ষ নেতাদের কাছে গুরুঙ্গ এ দিন স্পষ্ট করে দিয়েছেন, কেন্দ্র এবং রাজ্যের সঙ্গে সমন্বয় রাখার জন্য তিনি প্রশাসনিক ভাবে একটি ‘সমন্বয় সেল’ গড়তে চান। মোর্চা অন্দর সূত্রের খবর, দলে ঘনিষ্ঠদের কাছে মোর্চা সভাপতি এ দিনও বলেছেন, “পাঁচ বছরের জন্য অনেক বড় দায়িত্ব আমাদের কাঁধে এসে পড়ছে। দায়িত্ব পালনে কোনও ফাঁকিবাজি চলবে না। অতীত থেকে শিক্ষা নিয়ে ভবিষ্যতের দিকে এগোতে হবে। কেন্দ্র ও রাজ্য তো বটেই আমরা সব দল, সব মানুষের সহযোগিতা নিয়েই এগোতে চাই।” |
দার্জিলিং
গোর্খা পার্বত্য পরিষদ
(ডিজিএইচসি) |
• চুক্তি ১৯৮৮-তে।
•
সদস্য ৩৩ (নির্বাচিত ২৮, মনোনীত ৫)।
• শীর্ষে চেয়ারম্যান সুবাস ঘিসিং (জিএনএলএফ)।
• দফতর: ১৯।
• এলাকা: পাহাড়ের ৩ মহকুমা এবং শিলিগুড়ির ১৩টি মৌজা।
• কেন্দ্রীয় বরাদ্দের পরিমাণ চুক্তিতে উল্লেখ ছিল না।
•
রাজ্যের কাছে নিয়মিত রিপোর্ট জমা দিত না ডিজিএইচসি। |
গোর্খাল্যান্ড
টেরিটোরিয়াল অ্যাডমিনিস্ট্রেশন
(জিটিএ) |
• চুক্তি ২০১১-য়।
• সদস্য ৫০ (নির্বাচিত ৪৫, মনোনীত ৫)।
• শীর্ষে চিফ এগজিকিউটিভ বিমল গুরুঙ্গ (গোর্খা জনমুক্তি মোর্চা)
• দফতর: ৫৯।
• এলাকা: পাহাড়ের ৩ মহকুমা, শিলিগুড়ির ১৩টি মৌজা। আরও ৫টি মৌজার সুপারিশ রয়েছে।
•
৩ বছর কেন্দ্র দেবে ২০০ কোটি। রাজ্যও টাকা দেবে।
•
রাজ্যপালের কাছে বাৎসরিক রিপোর্ট দেবে জিটিএ। |
|
সহযোগিতা পাওয়ার ব্যাপারে গুরুঙ্গের তৎপরতা এ দিন রীতিমতো চোখে পড়েছে। দার্জিলিঙে জিটিএ-র শপথগ্রহণ অনুষ্ঠানে যোগ দিতে আসা কেন্দ্র ও রাজ্যের জনপ্রতিনিধিদের কাছে গিয়ে তিনি জিটিএ চালানোর জন্য সাহায্যের আশ্বাস চেয়েছেন। আলাদা করে সাহায্য পাওয়ার আশ্বাস চেয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এবং কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সুশীলকুমার শিন্দের কাছে। গুরুঙ্গের এই ‘তৎপরতা’ দেখে উত্তরবঙ্গ উন্নয়নমন্ত্রী গৌতম দেব বলেছেন “উনি যে জিটিএ পরিচালনাকে কতটা গুরুত্ব দিচ্ছেন, সেটা পরিষ্কার। আশা করি, উনি প্রশাসক হিসেবে সব চ্যালেঞ্জের মোকাবিলা করতে পারবেন।”
মুখ্যমন্ত্রীও বলেছেন, “অনেক দিন পরে পাহাড়ে শান্তি ফিরেছে। এক বছরের মধ্যে চুক্তি করে, ভোট করিয়ে, জিটিএ গঠন করাটা ঐতিহাসিক ব্যাপার। আমরা জিটিএ-র পাশে রয়েছি।” আর এ দিন সন্ধ্যায় দার্জিলিঙে জিটিএ প্রসঙ্গে মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে একপ্রস্ত আলোচনার পরে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী শিন্দে বলেছেন, “আমার বোন মমতা জিটিএ-তে তরুণ প্রজন্মকে নতুন দায়িত্ব দিয়েছেন। আমরাও জিটিএ-কে সব রকম সাহায্য করব। মমতার নেতৃত্বে জিটিএ-র পরিচালনায় এই তরুণ প্রজন্ম ভাল কাজ করবে বলে আমার ধারণা।”
তবে শুধু সাহায্যের প্রতিশ্রুতি নয়, মোর্চার সমালোচনাও করেছে কোনও কোনও মহল। জিএনএলএফের কেন্দ্রীয় কমিটির এক নেতার যেমন কটাক্ষ, “প্রার্থী প্রত্যাহার করার পরেও জিটিএ নির্বাচনে ৮ শতাংশ ভোট পেয়েছে তৃণমূল। ওরা পুরোদস্তুর ভোটে লড়লে কী ফল হত, গুরুঙ্গ নিশ্চয় বুঝেছেন। ওঁর কপালে ভাঁজ পড়াই তো স্বাভাবিক!”
|
আজ শপথ জিটিএ-র |
বাগডোগরায় মুখ্যমন্ত্রী। |
দার্জিলিঙে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সুশীলকুমার শিন্দের
সঙ্গে মুখ্যমন্ত্রী। রয়েছেন বিমল গুরুঙ্গ ও রোশন গিরি। |
দার্জিলিঙের পথে সাংসদ যশোবন্ত সিন্হা। |
দার্জিলিঙের পথে রাজ্যপাল এম. কে. নারায়ণন। |
|
ছবিগুলি তুলেছেন সন্দীপ পাল। |
|