জনলোকপাল বিল পাশ করার দাবিতে রাজধানীর যন্তর-মন্তর চত্বরে অণ্ণা হজারে আবার অনশনে বসিয়াছেন। তাঁহার পারিষদরা আগেই শুরু করিয়াছিলেন। তবে তাঁহাদের আন্দোলনে এ বার আর তত সাড়া মিলিতেছিল না। যন্তর-মন্তর বেশ ফাঁকাই পড়িয়াছিল। অণ্ণা হজারে ‘আমরণ অনশনে’ বসিতেই ভিড় বাড়িতে শুরু করে। ভিড়ের অন্য একটি কারণ সম্ভবত দিনটি রবিবার, অর্থাৎ ছুটির দিন হওয়া। অণ্ণা হজারের আন্দোলনের জনসমর্থন এখনও কতটা, তাহা সপ্তাহ জুড়িয়া বুঝা যাইবে। তবে ‘টিম অণ্ণা’র কোনও কোনও সদস্য যে ইহাকে ‘করেঙ্গে ইয়া মরেঙ্গে’ আন্দোলন বলিয়া আস্ফালন করিয়াছেন, তাহা একটু বেসুরো ঠেকিতেছে। গাঁধীবাদী অণ্ণার আন্দোলনকে প্রথমাবধি তাঁহার সহগামীরা মহাত্মার আন্দোলনের সহিত অভিন্ন সারিতে বসাইবার চেষ্টা করিয়া আসিয়াছেন। কিন্তু জনপ্রিয়তা সত্ত্বেও গাঁধীর আন্দোলন ও নেতৃত্বের যে নৈতিক শক্তি ছিল, জনলোকপাল বিলের দাবিতে জনসমাবেশ সংগঠনের প্রয়াসে তাহা নাই।
নৈতিকতার সমস্যাটি সৃষ্টি হইয়াছে প্রধানত আন্দোলনের তীব্র কংগ্রেস-বিরোধী অবস্থানের কারণে। আন্দোলনের মঞ্চ হইতে ইউপিএ সরকার ও তাহার দুর্নীতি-অনিয়ম-কেলেঙ্কারিকে ধিক্কার জানানো হইলেও বিরোধী দল বিজেপির সরকারের অপকর্মগুলি সম্পর্কে রহস্যজনক মৌন অবলম্বন করা হইয়াছে। অণ্ণা নিজে গুজরাতের মুখ্যমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী ও ২০০২-এর সংখ্যালঘু নিধন সম্পর্কে নীরব থাকিয়াছেন। তাঁহার সহিত যোগগুরু রামদেবের ঘনিষ্ঠতা লইয়াও প্রশ্ন উঠিয়াছে। বিশেষত রামদেব গুজরাতে মোদীর সহিত প্রকাশ্য মঞ্চে যে নিবিড় ঘনিষ্ঠতা দেখাইয়াছেন এবং যে ভাবে দ্বিধাহীন প্রশংসায় মোদীকে ভরিয়া দিয়াছেন, তাহাতে ‘টিম অণ্ণা’র অনশনরত সদস্যদের মধ্যেই ক্ষোভ সৃষ্টি হইয়াছে। মোদী যে তাঁহার রাজ্যে লোকায়ুক্ত বিল পাশ করান নাই, পছন্দের লোকায়ুক্ত নিয়োগ লইয়াও রাজ্যপাল ও হাইকোর্টের সহিত দ্বন্দ্বে জড়াইয়াছেন, তাহা অণ্ণার অগ্রাহ্য করার মতো বিষয় নয়। কর্নাটকে বিজেপি সরকার যে দুর্নীতিপরায়ণতার জন্য ক্রমাগত লোকায়ুক্ত ও সিবিআই আদালতের ভর্ৎসনার শিকার হইতেছে, তাহা লইয়াই বা ‘টিম অণ্ণা’র বিচলন কই? সংশয় জাগিয়াছে, জনলোকপাল বিলের দাবিতে আন্দোলন কি তবে সংঘ পরিবারের মদতপুষ্ট আন্দোলন, কেন্দ্রীয় শাসক দল কংগ্রেসকে কোণঠাসা করাই যাহার অভিপ্রায়? পাশাপাশি আন্দোলনটিকে নাগরিক আন্দোলনের পরিসরে সীমাবদ্ধ না রাখিয়া তাহাকে রাজনৈতিক চেহারা দেওয়ার চেষ্টা লইয়াও প্রশ্ন উঠিতেছে। অণ্ণা হজারে বলিতেছেন, ২০১৪ সালের লোকসভা নির্বাচনে তাঁহারা প্রার্থী দিবেন। যাহারা লঙ্কায় যায়, তাহারাই যে রাবণ হইয়া ওঠে, এই জনপ্রবচনে বিশ্বাসী আমজনতা ভাবিতে পারেন, নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের দুর্নীতি ও আর্থিক কেলেঙ্কারিতে অধঃপতিত হওয়ার নমুনা হিসাবে ‘টিম অণ্ণা’ যে তালিকা প্রকাশ করিয়া থাকে, তাহাতে অতঃপর অনশনমঞ্চের কুশীবদের দেখা যাইবে না তো!
অণ্ণা হজারের আন্দোলন যে আগের জনসমর্থন ধরিয়া রাখিতে ব্যর্থ, তাহা দিবালোকের মতো স্পষ্ট। কেবল যে যন্তর-মন্তরের ভিড়ই পাতলা হইয়াছে, তাহা নয়, সারা দেশের বিভিন্ন রাজ্যের রাজধানীতে ও অন্যান্য শহরে এক বছর আগে এই আন্দোলন যে সংহতিসূচক তৎপরতা সৃষ্টি করিয়াছিল, তরুণ সম্প্রদায়ের মধ্যে যে প্রত্যাশা ও উত্তেজনা জাগাইয়াছিল, তাহা আজ বহুলাংশেই স্তিমিত। তাহার অর্থ এই নয় যে, দুর্নীতির প্রতিরোধে ও প্রতিকারে সরকারের অনেক বেশি তৎপর হইবার প্রয়োজন নাই। অবশ্যই আছে। বস্তুত, বিভিন্ন উপলক্ষে শাসক গোষ্ঠী দুর্নীতি রোধে আপন অনীহার বিষয়টিই প্রকারান্তরে প্রকট করিতেছে। তবে এ ব্যাপারে বিরোধী দল বিজেপিও দায়ী। সংসদের বাহিরে অণ্ণার আন্দোলনের প্রতি সহমর্মিতা দেখাইলেও সংসদে বিশেষত রাজ্যসভায় বিলটি পাশ করাইতে বিজেপি সাহায্য করে নাই, চাপ দেওয়া তো দূরস্থান। আর বিল পর্যালোচনার সংসদীয় কমিটিতে বিজেপি সাংসদদের ভূমিকাও অণ্ণা-সমর্থকের নয়। কংগ্রেসের মতো বিজেপিও লোকপাল লইয়া রাজনীতি করিতেছে। অণ্ণা হজারে প্রকারান্তরে তাহার শরিক হইয়া পড়িয়াছেন। |