|
|
|
|
প্রবন্ধ ১... |
আধিপত্য বিস্তারের উদ্যোগই অশান্তির মূল |
অসমে যে অশান্তির বিস্ফোরণ ঘটল আরও এক বার, তার পিছনে
আছে
এক দীর্ঘ এবং দুর্ভাগ্যজনক ইতিহাস। বিশ্লেষণ করেছেন
সন্তোষ রাণা |
নমনি অসমের কোকরাঝাড়, চিরাঙ, বঙ্গাইগাঁও, উদালগুড়ি এবং মোহিতপুর এই পাঁচ জেলায় সাম্প্রতিক জাতিদাঙ্গার প্রধান দুই পক্ষ বড়ো এবং মুসলমানরা। মূলত দ্বিতীয় পক্ষটিই আক্রান্ত। রেল লাইনের উত্তরে ভুটান সীমান্ত পর্যন্ত বিস্তৃত এলাকায় বড়ো অধ্যুষিত গ্রাম বেশি, দক্ষিণে কম। এই ভূভাগে বসবাসকারী অন্যান্য জনগোষ্ঠী হচ্ছেন সাঁওতাল ও অন্যান্য ঝাড়খণ্ডীরা, কোচ-রাজবংশীরা, বাংলাভাষী (বর্তমানে অসমিয়াভাষী) মুসলমানরা, কিছু বাঙালি হিন্দু ও অল্প কিছু অন্যান্য অসমিয়াভাষী মানুষ। এঁদের মধ্যে বড়ো, রাভা প্রভৃতি জনগোষ্ঠী তফসিলভুক্ত জনজাতি (এস টি)। এ রাজ্যে সাঁওতাল এবং অন্যান্য জনগোষ্ঠীদের এস টি মর্যাদা প্রত্যাহার করে নেওয়া হয়েছে।
|
বহুজাতিক অসম |
১৯৫০ সাল পর্যন্ত সাঁওতাল, মুণ্ডা, ওরাওঁ, হো, মাহালি প্রভৃতি ঝাড়খণ্ডী জনগোষ্ঠীগুলো ভারতের অন্যান্য রাজ্যের মতো অসমেও এস টি হিসেবে গণ্য হতেন। ১৯৫০-এ অসম সরকার এঁদের তফসিল থেকে বাদ দিয়ে দেয়। আজকের অসমের ২০ শতাংশ লোক এই জনগোষ্ঠীগুলোর মানুষ, যাঁদের মেহনতে সেখানকার চা-বাগান। উজনি অসমের কিছু জায়গায় তো এঁরা জনসংখ্যায় এক-তৃতীয়াংশেরও বেশি। এঁদের অশিক্ষা ও অনুন্নয়নের মধ্যে ফেলে রেখে চিরকালীন সস্তা বাগিচা-মজুর হিসেবে রেখে দেওয়াটাই ছিল এঁদের এস টি মর্যাদা কেড়ে নেওয়ার কারণ। এঁদের অবশ্য ওবিসি বলে বলে মানা হয়, কিন্তু ওবিসি-র জন্য সুযোগসুবিধা নগণ্য। ফলে এই কর্মজীবী মানুষরা চিরান্ধকারেই থেকে গেছেন। তফসিলভুক্ত হওয়ার জন্য এঁদের জোরাল দাবি আছে। কয়েক বছর আগে গুয়াহাটিতে এক তরুণীকে উলঙ্গ করে তাড়া করার ছবি গোটা দেশে আলোড়ন তোলে; সেই তরুণী ছিলেন এই আন্দোলনের সমর্থনে এক মিছিলের অংশভাগী। |
|
নিঃসহায়। উদ্বাস্তু শিবির, কোকরাঝাড়, অসম। ছবি: পি টি আই |
এ দিকে কোচ-রাজবংশীরা দীর্ঘদিন ধরে তফসিলভুক্ত হওয়ার জন্য আন্দোলন চালাচ্ছেন। জনসংখ্যার দিক দিয়ে রাজবংশীরা নিম্ন অসমে এক বৃহৎ জনগোষ্ঠী। তাই ভোটের হিসাব কষে কেন্দ্রের কংগ্রেস সরকার এঁদের এস টি হিসেবে তফসিলভুক্ত করবার জন্য অর্ডিন্যান্স পাশ করেছে, কিন্তু সেটা আইনে পরিণত হয়নি। রাজবংশীরাও ওবিসি হিসেবে চিহ্নিত। উল্লেখ্য যে, কোচ-রাজবংশীদের যে অংশটি পশ্চিমবঙ্গের বাসিন্দা, তাঁরা তফসিলি জাতি (এস সি) হিসাবে গণ্য হন। এঁরা পশ্চিমবঙ্গের সর্ববৃহৎ তফসিলি জাতিগোষ্ঠী।
বাংলাভাষী মুসলমানরা অসমে আসতে শুরু করেন ১৮৫০-এর পর। ব্রহ্মপুত্রের চর এলাকার জমি অত্যন্ত উর্বর, কিন্তু বন্যা সে জমিকে বন্ধ্যা করে রেখেছিল। ব্রিটিশ শাসকরা ওই এলাকাকে রাজস্ব আদায়ের যোগ্য করে তোলার জন্য ময়মনসিংহ ও অন্যান্য জেলা থেকে মুসলমান চাষিদের নিয়ে আসে। জলের মধ্যে চাষের প্রযুক্তি ছিল এই চাষিদের আয়ত্তে। বিংশ শতকের গোড়ার দিক থেকে এই অভিবাসনের মাত্রা বাড়ে। আজকের অসমে ব্রহ্মপুত্রের চর এলাকায় যে কৃষি-সমৃদ্ধি, তা প্রধানত এই মুসলমান চাষিদের অবদান। আবার বন্যার কারণে কিছু লোককে উত্তরে-দক্ষিণে অপেক্ষাকৃত উঁচু জায়গায় সরে যেতেও হয়েছে। ফলে রেল লাইনের উত্তরেও কিছু মুসলমান বসতি গড়ে উঠেছে।
ওই এলাকায় সাঁওতালদের নিয়ে আসা হয় ১৮৫৫-র বিখ্যাত সাঁওতাল-‘হুল’-এর পর। ব্রিটিশ সরকার সঙ্কোশ নদীর দুই তীরে শামুকতলা এজেন্সি তৈরি করে এঁদের বসায়। কৃষিকর্মে দক্ষ সাঁওতালরা বন-গাজাড় ভেঙে ওই এলাকাকে চাষের উপযোগী করে তোলেন। অন্যান্য ঝাড়খণ্ডীরা আসেন চা-বাগান স্থাপনের পর দাস শ্রমিক হিসেবে ব্রিটিশরা এঁদের নিয়ে আসে। বাগানে কর্মরত ওই এলাকায় চাষবাসে নিযুক্ত ঝাড়খণ্ডীরা নিজেদের মধ্যে সাদ্রিতে কথা বলেন, অন্যদের সঙ্গে অসমিয়াতে। সাঁওতালরা নিজেদের ভাষা রক্ষা করে চলেছেন, অবশ্য অসমিয়া অনুপ্রবেশ সহ। মোট কথা, ঝাড়খণ্ডীরা প্রধানত দ্বিভাষিক বা ত্রিভাষিক। দেশভাগের পর কিছু হিন্দু বাঙালিও এই এলাকায় বসতি স্থাপন করেছেন এঁরাও দ্বিভাষিক।
|
বড়ো আধিপত্য |
এই ভাবে, এক ঐতিহাসিক প্রক্রিয়ায় এক মিশ্র জনবসতি এলাকা গড়ে উঠেছে। এঁরা সকলেই কৃষিজীবী বা অন্যান্য দেহশ্রমজীবী। ভারতের অন্যান্য জায়গার মতোই এখানেও ক্ষুধা, দারিদ্র, অশিক্ষা ও অস্বাস্থ্য-র ঘোর রূপ। অনুন্নয়ন এঁদের সকলেরই সাধারণ সমস্যা। বিশেষ বিপর্যয় তখনই দেখা দিয়েছে, যখন এই মিশ্র জনবসতি এলাকায় কোনও একটি জনগোষ্ঠী নিজস্ব আধিপত্য বিস্তারের চেষ্টা করেছেন। নিম্ন অসমে নব্বইয়ের দশকে ‘বড়োল্যান্ড’ আন্দোলন শুরু হওয়ার পর এই এলাকায় বড় আকারের অশান্তির সূত্রপাত। বড়োদের মধ্যে দুটি সশস্ত্র গোষ্ঠী তৈরি হয় ন্যাশনাল ডেমোক্র্যাটিক ফ্রন্ট ফর বড়োল্যান্ড (এন ডি এফ বি) ও বড়ো লিবারেশন টাইগারস (বি এল টি)। প্রথমটি মূলত বড়ো খ্রিস্টানদের সংগঠন; ভুটানে ছিল এদের শিবির। বি এল টি-র পিছনে ছিল ভারত সরকারের মদত।
যে এলাকা নিয়ে বড়োল্যান্ড তৈরির দাবি করা হয়, সেটা ছিল মিশ্র জনবসতি এলাকা, বড়োরা সেখানে নিতান্তই সংখ্যালঘু। দুই সশস্ত্র গোষ্ঠী যেমন নিজেদের মধ্যে প্রচুর মারামারি করে, তেমনই অন্যদের উপরও বহু আক্রমণ চালায়। ১৯৯৬ সালে কোকরাঝাড়ে বড়ো উগ্রপন্থীরা মাত্র এক দিনে চারশো সাঁওতালকে খুন করে নেতৃত্বে ছিল এন ডি এফ বি। সেই আক্রমণে রেল লাইনের উত্তর দিকে যে লক্ষাধিক সাঁওতাল ঘরছাড়া হয়েছিলেন, তাঁদের অনেকেই এখনও আশ্রয়শিবিরে আছেন।
২০০৩ সালে ভারত সরকার বড়ো স্বয়ংশাসিত এলাকা (বি টি এ)-র দাবি মেনে নিল; ঘোষিত উদ্দেশ্য: শান্তিস্থাপন! কিন্তু, যে এলাকা নিয়ে বি টি এ-র গঠন, তাতে ২০০১ সালের লোকগণনা অনুযায়ী তফসিলি জনজাতির (এস টি) জনসংখ্যা মাত্র ১৮ শতাংশ, যার মধ্যে বড়ো ছাড়া রাভা এবং অন্যান্য কিছু জনজাতি অন্তর্ভুক্ত। এহ বাহ্য। বি টি এ-র যে কাউন্সিল তৈরি হল, তাতে বেশির ভাগ আসন এস টি-দের জন্য কার্যত বড়োদের জন্য সংরক্ষিত হল। এঁদের আধিপত্য জারি হল বাকি ৮২ শতাংশ লোকের উপর, যাঁদের মধ্যে আছেন সাঁওতাল, বাঙালি মুসলমান ও বাঙালি হিন্দু। কাউন্সিলের ক্ষমতায় বি এল টি-র বন্দুকবাজরা, যারা আবার অল বড়ো স্টুডন্টস ইউনিয়ন (আবসু) নামে ভোটে লড়ত। এলাকায় উন্নয়নের কেন্দ্রীয় ও রাজ্য সরকারের বরাদ্দ এদের কিছু নেতা-মস্তান লুটেপুটে খায়। সাধারণ বড়ো-সহ অন্যান্য জনসাধারণের অবস্থা খারাপ বই ভাল হয়নি।
|
‘বিদেশি’ ও ‘ডাউটফুল’ |
এখন, মিশ্র জনবসতির কোনও এলাকায় এক-পঞ্চমাংশ লোকের প্রতিনিধিদের বাকি চার-পঞ্চমাংশের উপর রাজত্ব চালাতে দিয়ে যদি স্থায়ী শান্তি অর্জন সম্ভব করাতে হয়, তা হলে তা হতে পারে সেই সংখ্যাগরিষ্ঠদের উচ্ছেদ করে। সেটাই করার চেষ্টা হচ্ছে, এবং এর জন্য আশ্রয় নেওয়া হয়েছে এক জাতিবিদ্বেষী গুজবের: বাংলাদেশ থেকে লক্ষ লক্ষ মুসলমান ঢুকে পড়ে অশান্তি সৃষ্টি করছে। এটা মিথ্যা। বরং সত্য এই যে, শতাধিক বছর ধরে যে মানুষরা অসমে বসবাস করে আসছেন, তাঁদের অবদমিত করে রাখার জন্যই তাঁদের মাথার উপর ‘বিদেশি’ লেবেলের খাঁড়া ঝুলিয়ে রাখা হয়েছে। বহু মানুষকে ভোটাধিকার থেকে বঞ্চিত করে রাখা হয়েছে। আমার এক বন্ধু ১৯৪৯ সাল থেকে গুয়াহাটির বাসিন্দা। ভোটার তালিকায় বাঙালি ব্রাহ্মণ এই মানুষটির নামের পাশে লেখা ‘ডি’ ডাউটফুল, সন্দেহজনক! চরের মুসলমানপ্রধান এলাকায় এ রকম বহু মানুষের উপরি পদবি ‘ডি’ এঁরা ভোট দিতে পারেন না।
গত ৩৫ বছরে নিম্ন অসমের ওই এলাকায় প্রায় প্রতি বছরই বহু বার গিয়েছি। সঙ্কোশ থেকে বড়পেটা রোড পর্যন্ত এলাকা হেঁটে ঘুরে বেড়িয়েছি। এ রকম উর্বর ও কুমারী জমি ভারতের কম জায়গাতেই আছে: বন্যার দুর্গতির পর মাটি পুনঃসঞ্জীবিত হয়। শুধু লাঙ্গল দিয়ে ধান ছড়িয়ে দিলে বিঘায় কুড়ি মণ ধান। রাসায়নিক সার ও কীটনাশক ছাড়াই বিঘাপ্রতি ১০ মণ সরষে। কারা ফলান এ শস্য? ভিন্ন ভিন্ন জাতির চাষিরা বড়ো যেমন আছেন, তেমনই আছেন সাঁওতাল, কোচ-রাজবংশী, মুসলমান ও বাঙালি হিন্দু। আগে এখানে বাংলা মাধ্যম স্কুল ছিল, ১৯৫০, ’৬০ ও ’৭১-এর দাঙ্গায় সেগুলো পুড়িয়ে দেওয়া হয়। এখন হয়েছে অসমিয়া স্কুল, যা বাঙালি হিন্দু ও মুসলমানরা মেনে নিয়েছেন। ঝাড়খণ্ডীদের কোনও কণ্ঠস্বর কখনও ছিল না।
|
সমমর্যাদা, সহাবস্থান, শান্তি |
১৯৮০-র দশকে অসমে ক্রমবর্ধমান জমি ও মজুরির আন্দোলন এবং গণতন্ত্রীকরণ ঠেকাতে অসমিয়া উগ্র জাতীয়তাবাদী শাসকবর্গ ‘বিদেশি খেদাও’ অভিযান চালায়। এটা শুরু হয় উজানি অসম থেকে। এই অভিযানের মধ্যেই ঘটে নেলি ও মোকালমুয়ার গণহত্যা পৃথিবীতে লোক নিধনের জঘন্য নজিরগুলোর মধ্যে এদের স্থান। কিন্তু শেষ পর্যন্ত সে উগ্র জাতীয়তাবাদের পশ্চাদপসরণ ঘটেছে। অসমে বসবাসকারী সব জনগোষ্ঠী মোটামুটি ভাবে অসমিয়া ভাষাকে মেনে নিয়েছে, কিন্তু তা শিবসাগরের ব্রাহ্মণ্যবাদী অসমিয়া নয় এর মধ্যে জায়গা করে নিয়েছে অন্যান্য ভাষার বহু শব্দ ও প্রভাব। (দ্রষ্টব্য, ‘ভাষা দমনের হাতিয়ার, অতএব উদ্ধারেরও’, দিলীপ ঘোষ, আনন্দবাজার পত্রিকা, ২০-১-২০১১) প্রক্রিয়াটি এখনও দুর্বল, কিন্তু সহাবস্থানের মধ্যে দিয়ে এর ভিত শক্ত হতে পারে।
কিন্তু তার জন্য চাই শান্তি। অসম সরকারের এই মুহূর্তে কাজ হচ্ছে শান্তি স্থাপন করা এবং ঘরছাড়াদের ঘরে ফেরানো। এই আশু কাজটি জরুরি। কিন্তু স্থায়ী শান্তির জন্য আরও কিছু করা দরকার। যে ভাবে বড়ো কাউন্সিল গড়া হয়েছে, সেটা নিজেই স্থায়ী অশান্তির উৎস। এই এলাকায় সুস্থিত শান্তির জন্য স্বয়ংশাসনের এমন রূপ দরকার, যা বড়ো, রাভা, মুসলমান, রাজবংশী, সাঁওতাল, বাঙালি হিন্দু সকলের সমান অধিকার ও সমমর্যাদা নিশ্চিত করবে। শুধু নামনি অসমই নয়, এর প্রভাব গোটা অসমের পক্ষেই গুরুত্বপূর্ণ। প্রথম কাজ, কেন্দ্রীয় ও রাজ্য সরকারের উদ্যোগে সব গোষ্ঠীকে নিয়ে আলোচনা। দ্বিতীয়, বি টি এ কাউন্সিলে সব জনগোষ্ঠীর আনুপাতিক প্রতিনিধিত্ব সুনিশ্চিত করা। এবং তৃতীয়, ঝাড়খণ্ডীদের তফসিলি জনজাতি এবং রাজবংশীদের তফসিলি জাতিভুক্ত করা। যে সব বড়ো পাহাড়ে থাকেন, তাঁরা এস টি হিসেবে গণ্য হন না, আবার সমতলের কারবি-রা এস টি নন এটা বদলাতে হবে। সব বড়ো এবং সব কারবি’কে এস টি হিসেবে গণ্য করতে হবে। এটাই হবে সহাবস্থানের ভিত্তি, আর সহাবস্থানেই শান্তির নিশ্চয়তা। |
|
|
|
|
|