সম্পাদকীয় ১...
দুই সভ্যতা
পূর্ব ও পশ্চিম আজও ভিন্নপথগামী। দুই পৃথিবীর মধ্যে পরিবহণ ব্যবস্থা ও সমাজমানসের সম্পর্কটি খতাইয়া দেখিলে সেই পুরাতন সত্যই ফিরিয়া আসে। পরিবহণ ব্যবস্থা, বিশেষত গণ-পরিবহণ ব্যবস্থাকে দুই পৃথিবী যে ভাবে দেখে, তাহার মধ্যে বহু যোজন পার্থক্যই তাহা স্পষ্ট করে। সম্প্রতি ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী ডেভিড ক্যামেরন তাঁহার সকল মন্ত্রী, সহকারী, সহযোগীকে নির্দেশ দিলেন যে, অলিম্পিক ক্রীড়া প্রতিযোগিতা চলাকালীন যদি তাঁহারা সরকারি প্রতিনিধি হিসাবে কিংবা দর্শক হিসাবে ক্রীড়াস্থলে যান, তবে যেন আবশ্যিক ভাবে গণ-পরিবহণ ব্যবস্থার উপরই নির্ভর করেন, ব্যক্তিগত গাড়ি, বিশেষত লিমুজিন, যেন না ব্যবহৃত হয়। তদুপরি, তাঁহারা যেন স্বাভাবিক পথই ব্যবহার করেন, ভিআইপি-চিহ্নিত ‘লেন’গুলি দিয়া চলাফেরা না করেন। এই নির্দেশের পিছনে যুক্তিটি স্পষ্ট। লন্ডন শহর এমনিতেই পরিবহণ-যানের আধিক্যে কাহিল, ইহার মধ্যেই নানা বন্দোবস্ত করিয়া ত্রিশ লক্ষাধিক অলিম্পিক অভ্যাগতর চলাফেরার ব্যবস্থা হইতেছে, ইত্যবসরে যদি ব্রিটিশ ভিআইপি-রা যথেচ্ছ গাড়ি ব্যবহারের কুদৃষ্টান্ত স্থাপন করেন, তবে আয়োজক দেশের পক্ষে তাহা লজ্জার বিষয় হইবে। ব্রিটিশ ভিআইপি এবং মন্ত্রিগণ অবশ্য এই নির্দেশে সুখী হন নাই, তবে তাহা সত্ত্বেও বোধ হয়, প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশ বিফলে যাইবে না।
প্রসঙ্গত, প্রধানমন্ত্রী ক্যামেরন কিন্তু ফাঁপা নির্দেশ দেন নাই, স্বয়ং হাতে-কলমে কাজটি করিয়া তবেই অন্যদের উপদেশদানে প্রবৃত্ত হইয়াছেন। ইতিমধ্যে একাধিক বার তাঁহাকে আকস্মিক ভাবে লন্ডন মেট্রো রেলের কামরায় দেখা গিয়াছে। কখনও তিনি পরীক্ষণ করিতেছেন, কখনও পরিদর্শনে চলিতেছেন। কোনও ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী, মুখ্যমন্ত্রী, কিংবা অন্যান্য মন্ত্রী এমন পদক্ষেপ লইতেছেন, ভাবাও দুঃসাধ্য নয় কি? তবে এই প্রয়াস কিন্তু কেবল ব্যক্তিবিশেষের নহে, কেবল ক্যামেরন-চালিতই নহে। ব্রিটিশ গণ পরিবহণ বিভাগ সুসংহত ভাবে ২০১১ সাল হইতে বারংবার সতর্কবাণী দিয়াছেন, সকল অলিম্পিক ভিআইপি যেন গণ-পরিবহণ ব্যবস্থা ব্যবহার করেন। অর্থাৎ ইহা একটি প্রশাসনিক মানসিকতা।
ক্যামেরনের এই সিদ্ধান্ত এবং নির্দেশের প্রেক্ষিতে ভারতীয় রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের মতামত জানিবার প্রয়াস করিলে তাঁহাদের অনেকেই স্পষ্টাক্ষরে নিজেদের মত জানাইয়াছেন। বাস্তবিক, অধিকাংশই এমন ভাবনা ভাবিতে সম্পূর্ণ নারাজ, নতুবা এমন ভাবনার পশ্চাতে যুক্তিপদ্ধতিটিই বুঝিতে বিলকুল অপারগ। বস্তুত, ভারতীয় প্রশাসনিক মহলে উঁকি মারিলে দেখা যাইবে ক্যামেরন নীতির ঠিক বিপরীত চিত্রটি। এ দেশের নেতারা নিজেরাও এই নীতি পালন করিবেন না, এবং সমানেই তাঁহাদের দৃষ্টিকৃপার দ্বারা সরকারি গাড়ির সংখ্যা ও ব্যবহার সীমাহীন ভাবে বাড়াইয়া যাইবেন। অন্যে পরে কা কথা, পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যেই গত কয়েক বৎসরে সরকারি চিহ্নলাঞ্ছিত, কিংবা লালবাতি-শোভিত গাড়ির ব্যবহারকারীর সংখ্যা লজ্জাকর হারে বাড়িয়াছে। বহু বার অঙ্গুলি নির্দেশ সত্ত্বেও, বিচারবিভাগীয় নির্দেশ সত্ত্বেও, এক বিন্দু লাভ হয় নাই। আর, আদেশ-নির্দেশই তো যথেষ্ট নহে, গণ-পরিবহণ ব্যবস্থার হাল যদি উন্নত না হয়, তবে নাগরিকদের (এবং নাগরিকদের নেতাদের) এই ব্যবস্থার মাধ্যমে যাতায়াতে উদ্বুদ্ধ করা কার্যত অসম্ভব। অথচ, পশ্চিমবঙ্গের মতো রাজ্যে কিন্তু সম্প্রতি কালে গণ-পরিবহণের হাল উত্তরোত্তর মন্দ হইতেছে, বাসের সংখ্যাও দ্রুতহারে কমিতেছে। সার্বিক ভাবে গণ-পরিবহণকে এই অসুস্থতা হইতে রক্ষা না করিলে ভবিষ্যৎ ভয়ঙ্কর। সন্দেহ হয়, পশ্চিমে পূর্বে এই দুই চিত্রের বৈপরীত্য নেহাতই আপতিক নহে, ইহার মধ্যে আসলে দুই ভিন্ন রাজনৈতিক সংস্কৃতির প্রকাশ। এক সংস্কৃতি ইতিহাসের পাকে পড়িয়া সামাজিক দায়ের প্রশ্নটিতে ক্রমেই অধিকতর জোর দিতেছে। অন্য সভ্যতায় রাজনীতি বলিতে এখনও কেবলই ব্যক্তিগত কিংবা দলগত সমৃদ্ধি ও ক্ষমতার আকর্ষণ, আর কিছু নহে।


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.