নতুন সরকারের প্রথম সাত মাসে রাজ্যে ৬৪২২টি বেআইনি আগ্নেয়াস্ত্র উদ্ধার করেছিল পুলিশ। পরের পাঁচ মাসে সেই সংখ্যাটা নেমে গিয়েছে ১০৫৬-তে।
তবে কি রাজ্যে বেআইনি অস্ত্রের রমরমা কমে গেল?
বাস্তব চিত্রটা তা নয় বলেই মনে করছেন একাধিক পুলিশকর্তা। বরং তাঁরা মানছেন, বেআইনি অস্ত্র উদ্ধার অভিযানে কিছুটা হলেও ভাটা পড়েছে। পরিস্থিতি বিচার করে সম্প্রতি চারটি কমিশনারেট ও সমস্ত জেলা পুলিশের কাছে ‘কড়া বার্তা’ গিয়েছে মহাকরণ থেকে। তাতে বেআইনি অস্ত্র উদ্ধারের কাজে পুলিশের ভূমিকায় কার্যত ক্ষোভ প্রকাশ করেছে রাজ্য প্রশাসন।
কেন এই হাল?
সিআইডি-র এক পদস্থ কর্তা বলেন, “বেআইনি অস্ত্র উদ্ধার করতে গেলে একটা দল তৈরি করা জরুরি, যারা সর্বক্ষণ এই কাজেই লেগে থাকবে। তারা ‘সোর্স’ মারফত খবর জোগাড় করবে, আড়কাঠিদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখবে এবং ডেরায় ডেরায় অভিযান চালাবে।” কিন্তু এত কম পুলিশ নিয়ে আইন-শৃঙ্খলার কাজ সামলে শুধুই অস্ত্রের পিছনে ছোটা কার্যত অসম্ভব বলে মত ওই সিআইডি কর্তার। তাঁর বক্তব্য, “রাজ্যের অধিকাংশ থানা চলছে অনুমোদিত পদের অর্ধেক পুলিশ নিয়ে। খুন, ডাকাতি, রাহাজানির তদন্ত করতেই দারোগারা নাজেহাল। এই পরিস্থিতিতে বেআইনি অস্ত্র উদ্ধারের ইচ্ছা থাকলেও উপায় হবে কী করে?” |
তা হলে প্রথম সাত মাসে উপায় হল কী ভাবে? রাজ্য প্রশাসনের বহু কর্তার যুক্তি, “দীর্ঘদিন এক ছন্দে চলার পর প্রথম ধাক্কাতেই নতুন সরকারের ‘মনোভাব’ বুঝে নিয়েছিল পুলিশ। তাই ক্ষমতায় এসে যখন বেআইনি অস্ত্র উদ্ধারের নির্দেশ দেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়, সর্বশক্তি নিয়ে তারা ময়দানে নেমে পড়ে। ফলও মেলে হাতেনাতে।”
কিন্তু পুলিশের সেই ‘উদ্যোগ’ যে বেশি দিন স্থায়ী হয়নি, বেআইনি অস্ত্র উদ্ধারের সরকারি তথ্যই সেই ইঙ্গিত দিচ্ছে। এবং এ ক্ষেত্রে দুষ্কৃতীদের একাংশের রাজনৈতিক শিবির পাল্টে শাসক দলের ছত্রচ্ছায়ায় চলে আসাকেও বেআইনি অস্ত্র উদ্ধারে ভাটা পড়ার অন্যতম কারণ হিসেবে চিহ্নিত করছেন কেউ কেউ। এক পুলিশকর্তা বলেন, “বহু জায়গাতেই অন্ধকার জগতের লোকজন ইতিমধ্যে ‘আশ্রয়’ বদলে নিয়েছে। ফলে নতুন সরকারের প্রথম দিকে পুলিশ যে ‘খোলা হাত’ পেয়েছিল, এখন পরিস্থিতি ঠিক তেমন নয়।”
এই যুক্তি মানেননি পুলিশকর্তাদেরই একাংশ। তাঁদের বক্তব্য, “গাফিলতি ঢাকতে এ সব অজুহাত দেওয়া হচ্ছে। কম লোক নিয়েও যে লক্ষ্যমাত্রার বেশি অস্ত্র উদ্ধার করা যায়, তার প্রমাণ তো নতুন সরকারের প্রথম সাত মাসেই মিলেছে।”
বস্তুত, দেশ জুড়ে বেআইনি আগ্নেয়াস্ত্রের সাহায্যে যত খুনের ঘটনা ঘটে, তার হিসাবের তালিকায় পশ্চিমবঙ্গের নাম বেশ উপরের দিকেই। সরকারি পরিসংখ্যান বলছে, ২০১১ সালে এ রাজ্যে ২১০৯ জন খুন হয়েছিলেন। তার মধ্যে ৩১৭ জনকে মারার ক্ষেত্রে বেআইনি আগ্নেয়াস্ত্র ব্যবহার করে দুষ্কৃতীরা। সেই হিসেবে ওই বছরে পশ্চিমবঙ্গের উপরে ছিল কেবল উত্তরপ্রদেশ, বিহার ও ঝাড়খণ্ড। তার আগের বছর, ২০১০-এ বেআইনি অস্ত্রের সাহায্যে খুনের নিরিখে তৃতীয় স্থানে ছিল পশ্চিমবঙ্গ। পুলিশি তথ্যও বলছে, এই রাজ্যে বেআইনি অস্ত্রের রমরমা অনেক আগে থেকেই। ২০০০ থেকে ২০১০ পর্যন্ত অস্ত্র আইনে প্রায় ১০ হাজার মামলা হয়েছে গোটা রাজ্যে।
স্বরাষ্ট্র দফতরের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, চলতি বছরের ১ জানুয়ারি থেকে ৩১ মে পর্যন্ত রাজ্যে ১০৫৬টি বেআইনি অস্ত্র এবং ২৩৭১টি তাজা কার্তুজ উদ্ধার করেছে পুলিশ। এর মধ্যে সব চেয়ে বেশি অস্ত্র বাজেয়াপ্ত হয়েছে মুর্শিদাবাদে। তার পরেই রয়েছে বর্ধমান। তিনটি কমিশনারেট ও ১১টি জেলা অস্ত্র উদ্ধারে দুই অঙ্কেও পৌঁছতে পারেনি। রেল পুলিশের স্থানও তালিকার নীচের দিকেই। সরকারি পরিসংখ্যান বলছে, গত পাঁচ মাসে হাওড়া ও খড়্গপুরের রেল পুলিশ মাত্র দু’টি বেআইনি আগ্নেয়াস্ত্র আটক করেছে। শিলিগুড়ি আর শিয়ালদহের ক্ষেত্রে সংখ্যাটা শূন্য! |