ইঙ্গিত নেই সমাধানের
সিটুর পরিবহণ ধর্মঘটে কড়া হুঁশিয়ারি মুখ্যমন্ত্রীর
বাস-মালিকদের সংগঠন আগেই ধর্মঘট ঘোষণা করেছিল। পেট্রোল, ডিজেলের মূল্যবৃদ্ধির প্রতিবাদে ওই ৩১ জুলাইয়েই ভোর পাঁচটা থেকে রাজ্য জুড়ে ২৪ ঘণ্টার পরিবহণ ধর্মঘটের ডাক দিল সিটু।
বাস, মিনিবাস, অটো, লরি, ট্যাক্সিচালকেরা ধর্মঘটে যোগ দেবেন বলে সিটু দাবি করায় ওই দিন কার্যত বন্ধের আশঙ্কা। এই ধর্মঘটের ‘কড়া মোকাবিলা’য় নেমে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় হুঁশিয়ারি দিয়েছেন, সাধারণ মানুষের দুর্ভোগ বাড়িয়ে যে সব বেসরকারি বাস সে দিন রাস্তায় নামবে না, তাদের লাইসেন্স বাতিল করা হতে পারে। সিটুর ডাকা ধর্মঘটে সামিল হলে সমস্ত পরিবহণ নিগমের ভর্তুকি বন্ধ করে দেওয়া হবে। সরকারি কর্মীরা গরহাজির থাকলে তাঁদের এক দিনের বেতন কাটা যাবে। সাধারণ মানুষের প্রতি মুখ্যমন্ত্রীর আবেদন, “নির্ভয়ে বেরোন। সরকার আপনাদের সঙ্গে আছে।”
মুখ্যমন্ত্রীর হুঁশিয়ারিকে অবশ্য আমল দিতে চায়নি সিটু। ধর্মঘটের ডাকে এখনও পর্যন্ত তারা অনড়। পরিবহণের হাল ফেরানোর জন্য মুখ্যমন্ত্রীর গড়া মন্ত্রিগোষ্ঠী এ দিন বাস-মালিকদের সংগঠনের সঙ্গে আলোচনায় বসে ধর্মঘটে না-যাওয়ার আবেদন জানিয়েছে। কিন্তু সংগঠনগুলির তরফেও কোনও পাকা কথা দেওয়া হয়নি। ফলে, রাজ্য সরকার নরমে-গরমে ধর্মঘট মোকাবিলার চেষ্টা চালালেও আগামী মঙ্গলবার ফের সংঘাতের আবহ তৈরি হয়েছে।
কিন্তু যাত্রী পরিবহণের মূল সমস্যা সমাধানের ইঙ্গিত গোটা ঘটনাপ্রবাহে নেই। বাস-মালিকদের বক্তব্য, বারবার যে ভাবে জ্বালানির দাম বাড়ছে, তাতে বাস ভাড়া না-বাড়ালে আর চলবে না। অথচ রাজ্য সরকার যেমন ভাড়া না বাড়ানোর ব্যাপারে অনড়, তেমন সিটুও রাজনৈতিক বাধ্যবাধকতার কারণে এ ব্যাপারে চুপ।
সিটু নেতৃত্বের অভিযোগ, লোকসান হওয়ার কারণে বাস-মালিকেরা বাস বসিয়ে দেওয়ায় পরিবহণ শ্রমিকেরা কাজ হারাচ্ছেন। এই সমস্যা সমাধানে তাদের দাওয়াই, সরকার পরিবহণে ভর্তুকি আর তেলের দামের উপরে কর ছাড় দিক। কিন্তু এমনিতেই ভর্তুকির বোঝায় নাভিশ্বাস ওঠা সরকারের পক্ষে আর যে নতুন দায় নেওয়া সম্ভব নয়, তা কবুল করছেন প্রশাসনের শীর্ষ কর্তারাই। এই অবস্থায় ভাড়া বাড়ানোই সব চেয়ে বাস্তবোচিত সমাধান হতে পারত বলে তাঁদের অনেকের মত। কিন্তু ‘জনমুখী’ রাজনীতির চাপে কী সরকার, কী বিরোধী দুই তরফেই অনুচ্চারিত থেকে যাচ্ছে সেই প্রসঙ্গ।
ভাড়া বৃদ্ধির দাবিতে তাঁরা যে ধর্মঘট করছেন না, তা জানিয়ে সিটুর রাজ্য সভাপতি শ্যামল চক্রবর্তী এ দিন বলেন, “বামফ্রন্ট যখন ক্ষমতায় ছিল, তখন তেলের দাম বাড়লেই বর্তমান মুখ্যমন্ত্রী বলতেন, রাজ্য সরকার কেন কর ছাড় দিচ্ছে না? মুখ্যমন্ত্রী হওয়ার পরে মমতা কেন সে পথে হাঁটছেন না?” শ্যামলবাবুদের দাবি, যাতে ভাড়া না-বাড়ে, তার জন্য রাজ্য সরকার পরিবহণে ভর্তুকি দিক।
সিটুর পরিবহণ শ্রমিক সংগঠনের অন্যতম নেতা সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের হিসেবে, রাজ্যে ১০ হাজার বেসরকারি বাসের মধ্যে ইতিমধ্যেই সাড়ে তিন হাজার বসে গিয়েছে। ফলে কর্মচ্যুত হয়েছেন প্রায় ১৮ হাজার পরিবহণ শ্রমিক। বাস সারানোর যন্ত্রাংশ সরবরাহ না-করায় গত এক বছরে প্রায় ৩০০ সরকারি বাসও বসে গিয়েছে। সরকারি পরিবহণের কর্মীরা দু’মাস বেতন পাননি বলে সিটুর অভিযোগ। তাদের হিসেবে, গত ক’মাসে প্রায় ১২ হাজার ট্যাক্সিচালক বেকার হয়েছেন।
কর্মসংস্কৃতির পক্ষে সওয়াল মুখ্যমন্ত্রীর। নেতাজি ইন্ডোরে পরামর্শ অর্থমন্ত্রীর সঙ্গে।
সিপিএমের শ্রমিক সংগঠনের এই বক্তব্য জানার পরেই আসরে নামেন স্বয়ং মুখ্যমন্ত্রী। তবে তার আগে এ দিন নেতাজি ইন্ডোর স্টেডিয়ামে শ্রম দফতরের অনুষ্ঠানে তিনি বলেন, “কর্মসংস্কৃতি কাকে বলে, পশ্চিমবঙ্গ তা দেখাতে শুরু করেছে। আগামী দিনে সারা দেশকেই দেখাবে।” মুখ্যমন্ত্রী দাবি করেন, যেখানে ২০১০-’১১ আর্থিক বছরে রাজ্যে ৬৬ লক্ষ শ্রম দিবস নষ্ট হয়েছিল, সেখানে তৃণমূল ক্ষমতায় আসার পরে ২০১১-’১২ অর্থবর্ষে মাত্র ৬৬ হাজার শ্রমদিবস নষ্ট হয়েছে।
পরে রাজনৈতিক ভাবে ধর্মঘট মোকাবিলার লক্ষ্যে মমতা বলেন, “আগের সরকার দু’লক্ষ কোটি টাকা ঋণ করে গিয়েছে। প্রতি মাসে তার সুদ গুণতে হচ্ছে আমাদের। তার পরেও ধর্মঘট ডেকেছে সিপিএম! ওরা যদি ধর্মঘট প্রত্যাহার না-করে, তা হলে তৃণমূল কর্মীরাও শনি ও রবিবার মিটিং-মিছিল করে বলবেন, দু’লক্ষ কোটি টাকা ফেরত চাই, ফেরত দাও!” সিটুর প্রতি মমতার হুঁশিয়ারি, “আগুনে পা দেবেন না! যথেষ্ট হয়েছে। অনেক ভদ্রতা দেখিয়েছি! আর নয়!”
দু’দিনের জেলা-সফরে বেরোনোর আগে মহাকরণ থেকে বাস-মালিকদের প্রতি তাঁর সাফ হুঁশিয়ারি, “কারা সে দিন রাস্তায় বাস নামাচ্ছেন, আমরা নজর রাখব। যাঁরা নামাবেন না, তাঁদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নিতে সরকার পিছপা হবে না। প্রয়োজনে ওই সব বাসের লাইসেন্স বাতিল করা হতে পারে।” বাস-মালিকদের প্রতি মমতার সতর্ক-বার্তা, “ধর্মঘট করলে জনগণ তিন দিন কষ্ট পাবেন। কিন্তু আপনাদের ৩০০ দিন কষ্ট পেতে হবে। সরকার জনগণের কষ্টের সমাধান করে দেবে। কিন্তু আপনাদের কী হবে?” একই সঙ্গে মুখ্যমন্ত্রীর আশ্বাস, ধর্মঘটের দিন বাসের কোনও ক্ষতি হলে বিমা সংস্থার কাছ থেকে ক্ষতিপূরণ আদায়ে সরকার ‘হস্তক্ষেপ’ করবে।
সরকারি পরিবহণে ভর্তুকির প্রসঙ্গ টেনে পরিবহণ সংস্থার কর্মীদেরও ‘সতর্ক’ করে দিয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী। বলেছেন, “সিটুর পায়ে পা মিলিয়ে ধর্মঘটে যাবেন না। মনে রাখবেন, আপনাদের জন্য বছরে ৬০০ কোটি টাকা ভর্তুকি দিচ্ছে সরকার। আর যদি তা না-হয়, তা হলে ওই টাকায় আমরা নতুন বাস কিনব। কেন কিছু সিপিএম নেতাকে পুষতে ভর্তুকি দেব?”
ধর্মঘট বন্ধে
• পথে না-নামা বেসরকারি বাসের লাইসেন্স বাতিল
• বাসের ক্ষতি হলে সাহায্যের আশ্বাস
• পরিবহণ সংস্থায় ভর্তুকি বন্ধের হুমকি
• ভর্তুকির টাকায় কেনা হবে নতুন বাস
• গরহাজির সরকারি কর্মীদের বেতন ছাঁটাই
শ্যামলবাবু আবার পাল্টা বলেছেন, “আশা করেছিলাম, মুখ্যমন্ত্রী সংবেদনশীল মনোভাব নিয়ে সুষ্ঠু সমাধানের জন্য পরিবহণ শ্রমিকদের আলোচনায় ডাকবেন! তাঁরা বিপরীত দিকে হাঁটলেন!” বাস-মালিকদের সঙ্গে সিটু বা সিপিএমের কোনও সম্পর্ক নেই এই দাবি করেই শ্যামলবাবুর বক্তব্য, “তৃণমূলের এক বিধায়ক ও পুরভোটের প্রার্থী বাস-মালিক। কে কার লাইসেন্স বাতিল করবেন? ওঁর (মুখ্যমন্ত্রী) নিজেরই তো পাঁচ বছরের লাইসেন্স! তেলের দাম বাড়লেই উনি আন্দোলনের কথা বলে নাটক করছেন! কিন্তু দিল্লিতে গিয়ে কিছু বলেন না।” প্রসঙ্গত, তেলের মূল্যবৃদ্ধি-জনিত পরিস্থিতি ও আরও কিছু বিষয়ে আলোচনার জন্য আজ, শুক্রবার বামফ্রন্টের বৈঠকও ডাকা হয়েছে।
সরকার-বিরোধী এই সংঘাতের মধ্যেই এ দিন বিধানসভায় শিল্পমন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের ঘরে বেসরকারি বাস-মালিক সংগঠনের প্রতিনিধিদের নিয়ে রাজ্য সরকারের মন্ত্রিগোষ্ঠীর সদস্যেরা বৈঠক করেন। পরে পার্থবাবু বলেন, “ধর্মঘটের পথে না-গিয়ে আলোচনার মাধ্যমে সমস্যা মেটানোর জন্য বাস-মালিকদের বলেছি।” উল্লেখ্য, পরিবহণ সমস্যা সমাধানে মুখ্যমন্ত্রীর নির্দেশে পার্থবাবু, অর্থমন্ত্রী অমিত মিত্র, পরিবহণমন্ত্রী মদন মিত্র ও বিদ্যুৎমন্ত্রী মণীশ গুপ্তকে নিয়ে ওই মন্ত্রিগোষ্ঠী গড়া হয়েছে। আগুনে পা দেবেন না! যথেষ্ট হয়েছে। অনেক ভদ্রতা দেখিয়েছি! আর নয়! মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়, মুখ্যমন্ত্রী



First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.