প্রবন্ধ ২...
যেন তৃতীয় লিঙ্গের ‘ধর্ষিত’ হওয়ারও ক্ষমতা নেই!
পিঙ্কি প্রামাণিক জামিন পেলেন। আদালত তার পর্যবেক্ষণে বলল, পিঙ্কির শরীরে নারী বা পুরুষ কারওই সুস্পষ্ট যৌনাঙ্গ নেই। সুতরাং তিনি ধর্ষণের অপরাধে অপরাধী হতে পারেন না। ধর্ষণের ‘ক্ষমতা’ই তাঁর নেই।
পিঙ্কি প্রামাণিকের লিঙ্গ নির্ধারণকে কেন্দ্র করে বেশ কিছুদিন যাবৎ যে ধরনের কর্মকাণ্ড চলেছে, সংবেদনশীল নাগরিক মাত্রেই তাতে শিউরে উঠেছেন। জামিন পাওয়াতে পিঙ্কি অন্তত কিছু দিনের জন্য ওই লাগাতার ‘অগ্নিপরীক্ষা’র (শব্দটি ব্যবহার করেছেন পিঙ্কি নিজেই) হাত থেকে রেহাই পাবেন, এটা ভেবে আমরা সকলেই আশ্বস্ত বোধ করছি। কিন্তু এই আবহে আরও কিছু প্রশ্ন যাতে আড়ালে চলে না যায়, সে দিকেও নজর রাখা জরুরি।
প্রশ্নগুলো ধর্ষণের সংজ্ঞা নিয়ে। আমরা মনে রাখব, পিঙ্কির লিঙ্গ পরীক্ষার প্রশ্ন উত্থাপিত হল ধর্ষণের অভিযোগ ঘিরেই। অভিযোগকারিণী দাবি করলেন, পিঙ্কি পুরুষ। তৎক্ষণাৎ ধর্ষণ এবং পুরুষত্বের প্রশ্নটা একসঙ্গে সেঁটে গেল। ধর্ষণের অভিযোগের সত্যাসত্য বিচারে পুরুষত্বের প্রমাণ একমাত্র পূর্বশর্ত হয়ে উঠল।
ধর্ষণ তার মানে শুধুমাত্র নারীর প্রতি শুধুমাত্র পুরুষের অপরাধ। সেই সূত্রে এটাকেও স্বতঃসিদ্ধ বলে মেনে নেওয়া হল, ধর্ষক হতে গেলে একটি পুংলিঙ্গ এবং ধর্ষিত হতে গেলে একটি স্ত্রী যৌনাঙ্গ থাকা বাধ্যতামূলক।
তৃতীয় লিঙ্গের মানুষের তবে কী হবে? আদালত যেমন পিঙ্কির ক্ষেত্রে বলেছে, ওঁর ধর্ষণ করার ‘ক্ষমতা’ নেই, তৃতীয় লিঙ্গের মানুষকে তবে বলা হবে, ওঁদের ধর্ষিত হওয়ার ক্ষমতা নেই? যৌন হিংসায় পীড়িতের অধিকার পেতে গেলে এবং ব্যক্তিগততার সীমানা লঙ্ঘিত হওয়ার বোধটুকু থাকতে গেলেও তবে শারীরবৃত্তীয় ভাবে শুধু নারীই হতে হবে? তৃতীয় লিঙ্গের সরকারি স্বীকৃতি যখন মিলছে (ভোটার তালিকায় এখন তৃতীয় লিঙ্গের নথিভুক্তি সম্ভব), তখন তাদের যৌন নিরাপত্তা এবং সমানাধিকারের দিকটাও ভাবার কথা! প্রশ্নগুলো পিঙ্কির দিকে অভিযোগের আঙুল তোলার জন্য নয়। বরং পিঙ্কি এবং তাঁর মতো আরও অনেকের প্রাপ্য মর্যাদা এবং অধিকারের দাবি আদায়ের সাপেক্ষেই তর্কটা চালিয়ে যাওয়া দরকার। নচেৎ তৃতীয় লিঙ্গের প্রতি সমাজে যে পরিমাণ যৌন নিপীড়ন চলে, তার সুরাহা কোনও দিনই হবে না।
তৃতীয় লিঙ্গই বা শুধু কেন? সমকামীদের ক্ষেত্রে যৌন হিংসার মাপকাঠি কী হবে, সেটাও তো বড় প্রশ্ন। দিল্লি হাইকোর্ট সমকামিতাকে অপরাধের তকমা থেকে মুক্তি দিয়েছে। সুপ্রিম কোর্ট যদি সেই রায় বহাল রাখে এবং সংসদ যদি ভারতীয় দণ্ডবিধির ৩৭৭ ধারা সংশোধন করে, দেশ জুড়ে সমকামিতা আইনি স্বীকৃতি পাবে। দুই নারীর মধ্যে যৌন হিংসাকে তখন কী নামে ডাকা হবে? কোন ধারায় তার মামলা হবে? শুধুই যৌন হেনস্থা? ধরেই নেওয়া হবে, বলপূর্বক যোনিসঙ্গম বা পায়ুসঙ্গম ব্যতিরেকে সব লঘু পাপ! অতএব লঘু দণ্ড?
সবল ও অবলা। তপন সিংহের ‘আদালত ও একটি মেয়ে’ ছবির একটি দৃশ্য।
বিষয়টা কেবল তৃতীয় লিঙ্গ, সমকামিতা ইত্যাদিরও নয় কিন্তু। বিষমকামী নারী-পুরুষের প্রসঙ্গও সমান গুরুত্বপূর্ণ। ধর্ষণকে শুধুমাত্র নারীর প্রতি পুরুষের বলপ্রয়োগের মধ্যে সীমায়িত রাখলে ধরে নিতে হয়, পুরুষের কোনও লঙ্ঘনের (ভায়োলেশন) অনুভব থাকতে পারে না। সবলতর/বয়সে বড়/প্রতিপত্তিতে বড় পুরুষের হাতে দুর্বলতর পুরুষের যৌন নিপীড়নকে তবে কোন জায়গায় রাখব? কোনও নারী কি কোনও দিন যৌনক্রিয়ায় বাধ্য করেননি কোনও পুরুষকে? করেন না? কাউকে ভয় দেখিয়ে বা বেহুঁশ করে যদি তার সঙ্গে যৌন সংসর্গ স্থাপন করা হয়, তা কি নারী-পুরুষ-তৃতীয় লিঙ্গ নির্বিচারে ধর্ষণ নয়? ধর্ষণ মানে কি শুধুই পেশিশক্তির ব্যবহার? মেয়েরা যেমন লোকলজ্জার ভয়ে অনেক নিগ্রহের কাহিনি গোপন করতে বাধ্য হন, পুরুষেরও সেই একই চাপ থাকে না কি? পৌরুষের পরাজয়ের আখ্যান সেই জন্যই সহজে সামনে আসে না। তাই বলে পিতৃতন্ত্রের মার শুধু মেয়েরাই খায়, এমন মনে করার কারণ নেই। শারীরবিজ্ঞানে এটা প্রমাণিত সত্য যে, যৌন সাড়া অনেক ক্ষেত্রেই একটি শারীরিক প্রতিবর্ত ক্রিয়া মাত্র। ধর্ষিতা নারী সন্তানসম্ভবা হলে যেমন মনে করার কোনও কারণ নেই, যা ঘটেছে, তার সম্মতিতে ঘটেছে। একই রকম ভাবে নিগৃহীত পুরুষের ক্ষেত্রেও বলা চলে না যে, তার পুংলিঙ্গের সক্রিয়তা তার সম্মতির অবশ্যম্ভাবী পরিচায়ক।
এত ক্ষণে আমরা সম্ভবত মূল প্রশ্নটায় এসে দাঁড়ালাম। সম্মতি। ধর্ষণের সংজ্ঞা নিয়ে পৃথিবী জুড়ে যত আলাপ-আলোচনা-তর্কবিতর্ক চলছে, সেখানে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব পাচ্ছে ‘সম্মতি’র প্রশ্নটাই (বৈবাহিক সম্পকের্র মধ্যে ‘অসম্মতি’র পরিসরটি তার মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ)। একটা মানুষ সত্যিই ‘হ্যাঁ’ বলেছিল কি না, দায়ে পড়ে/চাপে পড়ে/প্রতারিত হয়ে বলেছিল কি না/খানিক দূর এগিয়ে পিছিয়ে আসতে চেয়েছিল কি না/তার সম্মতি আংশিক ছিল কি না/তার অসম্মতির ভাষা বুঝতে চাওয়া হয়েছিল কি না অজস্র সম্ভাবনার কথা উঠে আসছে। এবং সেই সূত্রেই ক্রমশ সম্প্রসারিত হচ্ছে ধর্ষণের সীমানা। শুধুমাত্র অন্যতর যৌনতার স্বীকৃতির নিরিখেই নয়, নানাবিধ আলোড়ন ঘটছে তথাকথিত মূলস্রোতের যৌনতার আলোচনাতেও। একটি মানুষের যৌন অধিকারের সীমানা জোর করে লঙ্ঘন করা এবং তজ্জনিত মানসিক এবং শারীরিক ক্ষতির নির্ণায়ক কি হতে পারে শুধু একটি মাত্র যৌন প্রকরণের সংঘটন অথবা অসংঘটন? যদি তা না হয়, তা হলে ধর্ষণকে একটি মাত্র লিঙ্গ পরিচয়ে বেঁধে রাখা চলে কি?
প্রশ্নগুলো সহজ নয়, নতুনও নয়। আমেরিকার বিভিন্ন রাজ্য, ফ্রান্স, গ্রিস, কানাডা, নিউজিল্যান্ড, নরওয়ে, দক্ষিণ আফ্রিকা এবং আরও কিছু দেশে ধর্ষণের আইনি সংজ্ঞা বদলেছে। সেখানে হি (পুরুষ) বা শি (স্ত্রী)-এর বদলে পার্সন বা ব্যক্তির কথা বলা হচ্ছে। ধর্ষণ আইনে ভেদন (পেনিট্রেশন)-এর পরিসরকেও অনেক দূর ছড়ানো হয়েছে। শুধু লিঙ্গ দ্বারা যোনিসঙ্গম তো নয়ই, এমনকী সেক্স টয়-এর বলপূর্বক ব্যবহারকেও ধর্ষণের আওতায় ফেলা হচ্ছে। কারাগারে পুরুষ বন্দির প্রতি যৌন নিপীড়ন, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ছাত্রদের প্রতি নিপীড়নের (শিক্ষিকারা তার মধ্যে আছেন কিন্তু) ঘটনার বাস্তবতা, অন্যতর যৌনতার স্বীকৃতি এই বদলে বড় ভূমিকা নিয়েছে।
ভারতে? দণ্ডবিধির ৩৭৫ ধারায় ধর্ষণ মানে যৌনসংসর্গ স্থাপন আগেনস্ট ‘হার’ উইল, উইদাউট ‘হার’ কনসেন্ট... যদি না, মহিলা সংশ্লিষ্ট পুরুষটির বিবাহিতা স্ত্রী হন! অর্থাৎ আমাদের আইনে ধর্ষণ = স্ত্রী ব্যতীত অন্য নারীর প্রতি বলপূর্বক যৌনসংসর্গ স্থাপন। অর্থাৎ, আমাদের আইনে ধর্ষণ মানেই নারীর প্রতি পুরুষের অপরাধ। ধর্ষণ মানে, নারীর প্রতি পুরুষের অন্যতম অপরাধ নয়।
ফৌজদারি দণ্ডবিধি সংশোধন নিয়ে কেন্দ্র যে আলাপ-আলোচনা চালাচ্ছে, তার অন্যতম কিন্তু ৩৭৫-৩৭৬ ধারা। কেন্দ্রের কাছে প্রস্তাব রয়েছে, ধর্ষণকে সর্বার্থেই তার লিঙ্গকেন্দ্রিকতা থেকে বার করে আনা হোক। কেন্দ্রীয় আইন কমিশন (১৭২তম) নিজেই এই প্রস্তাব রেখেছে। ‘ধর্ষণ’ শব্দটাকেই বাতিল করে ‘যৌন নিগ্রহ’ বলার প্রস্তাবও রয়েছে। এ সব প্রস্তাব কার্যকর হবে কি না, সে কথা এখনই বলা যাচ্ছে না। কিন্তু তর্কবিতর্ক চালু আছে, থাকবে।
ন্যাশনাল ক্রাইম রেকর্ড ব্যুরো-র সাম্প্রতিক সমীক্ষায় ভারতে নথিভুক্ত অপরাধের তালিকায় পয়লা নম্বরে ধর্ষণ (২২৮৬৫০টি ঘটনা, ২০১১-য়)। বিষয়টাকে দু’দিক থেকে দেখা যায়। এক, নথিভুক্ত অপরাধ যখন, তা দেশের আইন মেনেই নথিভুক্ত। আমাদের দেশে এই জাতীয় অপরাধের নথিভুক্তির হার কী রকম, তা সকলেই জানেন। সুতরাং অপরাধের বাস্তব সংখ্যাটা কত, সেটা আন্দাজ করার চেষ্টা করা যেতে পারে। ধর্ষণের বর্তমান সংজ্ঞা যদি আরও প্রসারিত হয়, তা হলে আরও কত শত যৌন নিপীড়নের ঘটনা যোগ হবে, সেটা ভাবুন।
দুই, বর্তমান আইনি কাঠামোতেই দেখা যাচ্ছে, অবস্থা কতটা ভয়াবহ। এই আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি এবং আমাদের সমাজে ধর্ষিতার বাস্তব সংকটের গভীরতার নিরিখে ধর্ষণের সংজ্ঞা বদলে দেওয়া মানে, বলা হচ্ছে, তার গুরুত্ব কমে যাওয়া। অনেকটা মুড়িমিছরি এক করে ফেলার মতো। বলা হচ্ছে, নারী ধর্ষণের ঘটনার নিরিখে অন্যান্য উদাহরণ নেহাতই আণুবীক্ষণিক। সুতরাং তাই নিয়ে কথা বলা মানে মূল সমস্যা থেকে দৃষ্টি সরিয়ে নেওয়া।
এখন প্রশ্ন হল, ধর্ষণের সংজ্ঞা সম্প্রসারিত হওয়া মানে ধর্ষণে শাস্তির পরিমাণ কমে যাওয়া তো নয়। তা হলে গুরুত্ব কমে যাওয়া বা নজর সরানোর কথা উঠছে কেন? উঠছে, কারণ আসলে আমরা বিশ্বাস করি, এক জন তৃতীয় লিঙ্গের মানুষ ধর্ষিত হলে যতটা ক্ষতিগ্রস্ত হন, এক জন মহিলা তার চেয়ে ঢের বেশি। আমরা বাস্তব থেকে রাশি রাশি উদাহরণ দিই। বাস্তবটা বদলাবে কীসে? শুধু ধর্ষণ-এর চিরাচরিত সংজ্ঞা বাঁচিয়ে রেখে? কেন ধর্ষণকে আমরা আলাদা বন্ধনীতে না রেখে পারি না? কারণ আমাদের হাড়ে-মজ্জায় মিশে আছে একটাই ‘সত্য’ নারীর ‘ইজ্জত’ তার যোনিতে থাকে, পৌরুষের নিবাস লিঙ্গে। বিশ্বাস করি, নারীর ‘ইজ্জত’-এর ঠিকাদারি পুরুষের হাতে। সে যদি তা রক্ষা করতে না পারে, তা হলে সেই কাপুরুষের হাতে ‘চুড়ি’ পরিয়ে দেওয়া উচিত!
ধর্ষণের সংজ্ঞা বিস্তৃত করতে চাওয়ার পিছনে অতএব একটি নির্দিষ্ট দৃষ্টিকোণ রয়েছে। রাজনৈতিক দৃষ্টিকোণ। তার মধ্যে চিন্তন এবং যাপনে লিঙ্গকেন্দ্রিকতা থেকে বেরিয়ে আসার স্পর্ধা রয়েছে। নিপীড়ন ও নিপীড়িতের বিশিষ্টতাকে অস্বীকার না করেও একটা মৈত্রীবন্ধনে (ভ্রাতৃবন্ধন নয় কিন্তু) যুক্ত হওয়ার বাসনা রয়েছে। ধর্ষণকে প্রাথমিক ভাবে যৌন হিংসা এবং অসম্মতির অসম্মান হিসেবে দেখতে ভয়টা ঠিক কোথায়? ইজ্জতের ভকতি তথা লিঙ্গের শকতির একাধিপত্য কমে যাওয়ার চিন্তায় নয় তো?


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.