সংস্কার কর্মসূচির কঠোরতর প্রয়োগে কংগ্রেস আরও জনবিচ্ছিন্ন হবে।
২০১৪ সালে লোকসভা নির্বাচনে এই নির্মম সত্য অবশ্যই উঠে আসবে। লিখছেন
অসীম চট্টোপাধ্যায় |
অবশেষে, বিলম্বিত বোধোদয়ে, মমতাদেবী রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে প্রণববাবুকে সমর্থন জানালেন, চাঁদ সদাগরের বাঁ হাতে পুজো দেওয়ার মতো ‘কষ্ট করে’। এর ফলে দেশবাসী কংগ্রেস, তৃণমূল কংগ্রেস এবং সি পি আই এমকে এক ঘাটে এক যোগে প্রণববাবুকে ভোট দেওয়ার অভূতপূর্ব দৃশ্য দেখবে। এ ছাড়া ভোটের অঙ্কে অবশ্য মমতাদেবীর সমর্থনের তেমন কোনও গুরুত্ব নেই।
আমাদের সংবিধানে স্পষ্ট বলা আছে যে, ‘রাষ্ট্রপতি সাংবিধানিক বা আনুষ্ঠানিক রাষ্ট্রপ্রধান মাত্র’। বলা হয়েছে যে, যেখানেই সংবিধান রাষ্ট্রপতির সন্তোষ দাবি করে, সেখানে সন্তোষের অর্থ রাষ্ট্রপতির ব্যক্তিগত সন্তুষ্টি নয়, বরং মন্ত্রী পরিষদের সন্তুষ্টি। তাই বিশেষ কয়েকটি সন্ধিক্ষণ ছাড়া দেশের নীতি নির্ধারণে রাষ্ট্রপতির প্রত্যক্ষ ভূমিকার কোনও অবকাশ নেই। আমাদের সংশোধীয় ব্যবস্থায় রাষ্ট্রপতি জনসাধারণ দ্বারা প্রত্যক্ষ ভাবে নির্বাচিত হন না। তাই রাষ্ট্রপতি নির্বাচন ঘিরে সমগ্র দেশের আলোড়িত হওয়ার কথা নয়। তবুও অস্বীকার করা যাবে না যে, গত কয়েক মাস ধরে দেশ তথা সর্বভারতীয় রাজনীতি এই প্রশ্নে সরগরম থেকেছে। এর কারণ বোঝা কঠিন নয়। ২০০৯ সালের মতোই ২০১৪ সালে লোকসভা নির্বাচনে ভগ্ন জনাদেশ হওয়ার সম্ভাবনা প্রবল। নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা সম্ভবত কোনও দলই পাবে না। এই অনিশ্চিত অবস্থায় রাষ্ট্রপতির ইচ্ছাধীন ক্ষমতার গুরুত্ব অপরিসীম। দলীয় সংখ্যাধিক্য বা জোটের সংখ্যাধিক্য বিচার করে সরকার গঠনের জন্য আহ্বান করার জন্য তাঁর ইচ্ছাধীন বিচারবুদ্ধি ব্যবহার করতে পারেন। তাই, সকল দলই নিজের লোককে রাষ্ট্রপতি পদে আসীন করার জন্য উঠেপড়ে লেগেছে।
এতে অবাক হওয়ার কিছু নেই। কিন্তু বিস্ময়ের কথা হল, রাষ্ট্রপতি নির্বাচন প্রতিটি শক্তিজোটকে ধাক্কা দিয়েছে। আঞ্চলিক দলগুলির নেতানেত্রীদের রাজনৈতিক উচ্চাকাঙ্ক্ষা থাকতেই পারে এবং তার জন্য তাঁদের দৌড়ঝাঁপ করা স্বাভাবিক, কিন্তু রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের মতো নিরামিষ নির্বাচনের ধাক্কায় ইউ পি এ, এন ডি এ এমনকী বাম দলের ভগ্নদশা হওয়ার কথা নয়। ইউ পি এ অবশ্য এখন কিছুটা ঘর সামলাতে পেরেছে। দুই বড় শরিক এ আই ডি এম কে এবং বি জে পি’কে হারিয়ে এন ডি এ’কে ওই দুই দলের প্রার্থী পূর্ণ সাংমাকে সমর্থনের সিদ্ধান্ত নিতে হয়েছে। বাম জোটের ভগ্নদশা কিন্তু প্রকট। সি পি এম এবং ফরওয়ার্ড ব্লক যেখানে প্রণববাবুকে সমর্থনের কথা ঘোষণা করেছে, সেখানে সি পি আই এবং আর এস পি ভোটদানে বিরত থাকার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এর থেকেও মজার কথা হল, অবস্থানের এই ভিন্নতা সত্ত্বেও ইউ পি এ, এন ডি এ এবং বাম জোট ঘোষণা করেছে যে, তাদের জোটগত ঐক্য অক্ষুণ্ণ রয়েছে। আসলে যে সত্যটি কোনও রাজনৈতিক দলই স্বীকার করতে চাইছে না, সেটি হল, রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে দেশে বিদ্যমান রাজনৈতিক অস্থিরতার ছায়াপাত ঘটেছে। |
অবশেষে। প্রণববাবুকে সমর্থনের সিদ্ধান্ত ঘোষণা করছেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। |
এই ছায়াপাতের ঘটনা বিরল হলেও অভূতপূর্ব নয়। ১৯৬৯ সালে এই ভাবেই ভারতীয় অর্থনীতিতে রাষ্ট্রীয় পুঁজি ও ব্যক্তি-পুঁজির ভূমিকা নিয়ে তীব্র ও তিক্ত বিতর্ক এবং সিন্ডিকেট কংগ্রেস প্রার্থী সঞ্জীব রেড্ডির পরাজয় ও ইন্ডিকেট কংগ্রেস প্রার্থী ভি ভি গিরির জয় ভারতীয় রাজনীতির ইতিহাসে সন্ধিক্ষণের মর্যাদা পায়। ঘটনা হল, এখানেও অর্থনৈতিক সংস্কারের কর্মসূচি ও তার প্রয়োগ নিয়ে বিতর্ক রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে তার ছায়া ফেলে প্রতিটি জোটকে কমবেশি ছিন্ন-বিচ্ছিন্ন করে দিতে পেরেছে।
অর্থশক্তি ও প্রশাসনিক ক্ষমতাকে কাজে লাগিয়ে মেকিয়াভিলিয়ান কায়দায় কংগ্রেসের সাফল্যকে চিহ্নিত করার যত চেষ্টাই হোক না কেন, কংগ্রেসের সাফল্যের ও বিরোধীদের ব্যর্থতার রহস্য লুকিয়ে রয়েছে এখানেই। ঘটনা হল, অর্থনৈতিক কর্মসংস্থানের কর্মসূচি প্রায়শ রুদ্ধগতি হয়ে হোঁচট খেলেও নানা মহলের বিরোধিতা সত্ত্বেও কংগ্রেস সংস্কার কর্মসূচি জারি রাখতে পেরেছে। অন্য দিকে, এই কর্মসূচির প্রবল বিরোধিতা করেও বামপন্থীরা সহ বিরোধীরা এর বিরুদ্ধে দেশব্যাপী তেমন কোনও প্রতিরোধ আন্দোলন গড়ে তুলতে পারেনি। বিরোধীদের ছন্নছাড়া অবস্থার কারণ এটাই।
আসলে, আর্থিক সংস্কারের নামে নয়া উদারনীতির পরিণতিতে দেশ জুড়ে ক্রমবর্ধমান আর্থিক বৈষম্য ও বেকারি বৃদ্ধির ফলে মানুষজনের ক্রয়ক্ষমতা কমে গেছে। এর সঙ্গে নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যাদির ক্রমাগত মূল্যবৃদ্ধি প্রকৃত ক্রয়ক্ষমতাকে আরও সংকুচিত করেছে। ফলে দেশে অভ্যন্তরীণ চাহিদা কমে শিল্পোৎপাদনে ও দেশের অর্থনীতিতে মন্দাকে অনিবার্য করেছে। রফতানি বৃদ্ধির পথে এই মন্দাকে সামলানোর চিন্তায় পাশ্চাত্যের দেশগুলির অর্থনৈতিক সঙ্কট জল ঢেলে দিয়েছে। লক্ষণীয়, চিনের মতো যে-সব দেশে অভ্যন্তরীণ বাজার শক্তিশালী, সেখানে আন্তর্জাতিক মন্দা তেমন কোনও প্রভাব ফেলতে পারেনি। বিগত দুই দশকে বি জে পি পরিচালিত এন ডি এ এবং কংগ্রেস পরিচালিত ইউ পি এ সরকারের নয়া উদারনীতির কল্যাণে দেশের অভ্যন্তরীণ বাজার ক্রমশ সংকুচিত হয়েছে। দেশের রাজনৈতিক অস্থিরতার আসল কারণ এখানেই নিহিত, যার আঁচ পড়ছে রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে।
এই নির্বাচনে উন্মোচিত ইউ পি এ জোটের টানাপড়েন লক্ষণীয়। ২০১৪ সালে লোকসভা নির্বাচনের দিকে তাকিয়ে অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধি ও একের পর এক দুর্নীতি কাণ্ডে বিপর্যস্ত কংগ্রেস থেকে ইউ পি এ শরিকরা দূরত্ব রচনা করতে চাইছেন। কিন্তু সংস্কার কর্মসূচির বিরুদ্ধে তেমন কোনও প্রতিরোধ আন্দোলন গড়ে না ওঠায় এবং তার ফলে বাস্তবোচিত কোনও বিকল্পের অভাবে তাঁরা ইউ পি এ জোটে আপাতত থেকে যেতে বাধ্য হচ্ছেন।
একমাত্র ব্যতিক্রম মমতাজির তৃণমূল কংগ্রেস। সকলেই জানেন যে, মমতাদেবী খুচরো ব্যবসায়ে বিদেশি বিনিয়োগ, বিলগ্নিকরণ, পেনশন বিল, জ্বালানির মূল্যবৃদ্ধি ইত্যাদির বিরোধিতা করেছেন। কিন্তু সংস্কার কর্মসূচির এই সব গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলির বিরোধিতা করলেও এই প্রশ্নে কোনও ‘সিরিয়াস’ আন্দোলন গড়ে তোলার পথে তাঁর বাধা তিনটি।
এক, তিনি বৃক্ষ দেখেন, অরণ্য দেখেন না। বিচ্ছিন্ন ভাবে বিষয়গুলির বিরোধিতা করলেও সংস্কার কর্মসূচির সামগ্রিক বিরোধিতা করেন না।
দুই, তাঁর বিরোধিতা প্রচারমূলক বক্তব্য-ভিত্তিক। রাজনৈতিক উদ্যোগ নিয়ে সর্বভারতীয় আন্দোলন গড়ে তোলার দৃষ্টিভঙ্গি, মানসিকতা বা উপাদান তাঁর নেই।
তিন, যে-কোনও আন্দোলন দাবি করে, অন্যান্য প্রশ্নে মতবিরোধ সত্ত্বেও এই প্রশ্নে সমচিন্তার দলগুলির সঙ্গে ঐক্য।
ঘটনা হল, এই সব প্রশ্নে একমাত্র বামপন্থীরাই লাগাতার, ধারাবাহিক, নীতিনিষ্ঠ অবস্থান গ্রহণ করেছেন। তাই, এই প্রশ্নে আন্দোলন গঠন বামপন্থীদের সঙ্গে ঐক্যবদ্ধ সংগ্রাম দাবি করে, যা অন্ধ সি পি আই এম বিরোধিতার কারণে মমতাদেবীর কাছে গ্রহণযোগ্য নয়। এর ফল হয়েছে এটাই যে, মমতাদেবীর এই সব প্রশ্নে বিরোধিতা বন্ধ্যা থেকেছে এবং আন্দোলনের ক্ষেত্রে বিভেদপন্থী হয়েছে। ফলে এই সব প্রশ্নে দিল্লিও মূক ও বধির থেকে তিনি রাজ্যে ফিরে বিরোধিতা করেছেন। ইতিহাসের পরিহাস হল, যে মমতাদেবী একদা কংগ্রেস ও বামপন্থীদের ‘দিল্লিতে দোস্তি, রাজ্যে কুস্তি’ বলে বিঁধেছেন, এখন তিনি নিজেই সেই অভিযোগে অভিযুক্ত হচ্ছেন। এর ওপর সর্বভারতীয় রাজনীতির জল না বুঝেই মাত্র ১৯ জন সাংসদ নিয়ে ‘মাছ’ ধরতে নেমে তিনি এতটাই হতমান হয়েছেন যে এখন তাঁর বিরোধিতাকে কোনও মর্যাদা না দিয়েই কংগ্রেস নেতৃত্ব সরাসরি অবজ্ঞার পথ ধরেছেন, যা উপরাষ্ট্রপতি পদে প্রার্থী নির্বাচনে প্রকট হয়ে পড়েছে।
প্রত্যাশিত ভাবেই সংস্কার কর্মসূচির বিরোধিতায় অগ্রণী ভূমিকা নেওয়া বি জে পি-র নেতৃত্বাধীন এন ডি এ-র পক্ষে সম্ভব নয়। কারণ, বি জে পি নিজেই সংস্কার কর্মসূচির উদ্গাতা ও অনুসারী। কিন্তু সবচেয়ে করুণ দশা বামপন্থীদের। সর্বভারতীয় রাজনীতিতে এমন করুণ দশা ইদানীং কালে বামপন্থীদের ছিল না। কারণ হিসেবে সংখ্যাহীনতার কথা উঠতে পারে, কিন্তু ভোলা যাবে না এই সত্য যে, এর থেকেও কম সংখ্যক সাংসদ নিয়ে জ্যোতিবাবু-সুরজিতরা রাজনৈতিক উদ্যোগ গ্রহণ করে বামপন্থীদের মর্যাদা অক্ষুণ্ণ রেখেছিলেন।
শেষ কথা একটাই। অর্থমন্ত্রী প্রণববাবু নিশ্চিত ভাবে সংস্কার কর্মসূচির পক্ষে ছিলেন। কিন্তু তিনি শিল্পমহল ও মার্কিন লবির দাবি মতো সংস্কার কর্মসূচির গতিবৃদ্ধিতে সায় দেননি। অর্থমন্ত্রক থেকে তাঁর প্রস্থানে ও প্রধানমন্ত্রী স্বয়ং মন্ত্রকের দায়ভার নেওয়ায় নতুন সুযোগের উন্মোচনের সম্ভাবনায় শিল্পমহল উল্লসিত। এই উল্লাস এতটাই তীব্র যে স্বয়ং ওবামাসাহেবও আসরে নেমে পড়েছেন। কিন্তু এন ডি এ আমলের ‘উজ্জ্বল ভারত’-এর তিক্ত অভিজ্ঞতা ভোলার নয়। শিল্পমহলের চাঁই ও তাদের স্তাবকদের সম্মিলিত চিৎকারে বি জে পি নেতারা ভেবেছিলেন যে সারা দেশ ‘উজ্জ্বল ভারত’-এর পক্ষে রয়েছে। ২০০৪ লোকসভা নির্বাচনে তাঁদের মোহভঙ্গ ঘটে। আসলে অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক ক্ষেত্রের ‘লজিক’ ভিন্ন। অর্থনীতি ক্ষেত্রে যাদের ক্রয়ক্ষমতা বেশি, তাদের গলার জোর বেশি। কিন্তু রাজনীতির ক্ষেত্রে সকলের সমান অধিকার প্রত্যেকের একটিই ভোট। এই বাস্তবতা রাজনৈতিক নেতারা প্রায়শই ভুলে যান। সংস্কার কর্মসূচিতে ইতিমধ্যেই কংগ্রেসের জনপ্রিয়তা কমেছে। বর্ধিত রাষ্ট্রীয় বিনিয়োগের বদলে সংস্কার কর্মসূচির কঠোরতর প্রয়োগে কংগ্রেস আরও জনবিচ্ছিন্ন হবে। ২০১৪ সালে লোকসভা নির্বাচনে এই নির্মম সত্য অবশ্যই উঠে আসবে। |