দার্জিলিঙের গোর্খা আঞ্চলিক প্রশাসনের (জি টি এ) নির্বাচনের দিন ঘনাইয়া আসিতেছে। তবে ভোটাভুটি ছাড়াই গোর্খা জনমুক্তি মোর্চার প্রার্থীদের, বস্তুত, গোটা জি টি এ-র আধিকারিকদেরই ‘নির্বাচিত’ বলিয়া ঘোষণা করার সম্ভাবনা এখন সমুজ্জ্বল। কারণ প্রথমে বামপন্থী প্রার্থীরা ভীতিপ্রদর্শন এবং পাহাড়ে গণতান্ত্রিক পরিবেশের অভাবের যুক্তি দিয়া প্রতিদ্বন্দ্বিতা হইতে সরিয়া দাঁড়াইতে বাধ্য হন। ইহার ফলে প্রায় অর্ধেক আসনে ইতিমধ্যেই বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় মোর্চার প্রার্থীদের ‘জয়ী’ ঘোষণা করিয়া দেওয়া হয়। ইহার পরেও তৃণমূল কংগ্রেসের প্রার্থীরা জি টি এ-র ১৭টি আসনে মনোনয়নপত্র পেশ করিয়াছিলেন, যেগুলিতে ভোটাভুটি অনিবার্য ছিল। কিন্তু বিমল গুরুঙ্গ কোনও প্রতিদ্বন্দ্বিতা চাহেন নাই। তাঁহার অভিপ্রায় ছিল, পার্বত্য দার্জিলিঙে অবিসংবাদী শক্তি হিসাবে গোর্খা জনমুক্তি মোর্চাকে প্রতিষ্ঠিত করা। বাম প্রার্থীরা লড়াই হইতে সরিয়া যাওয়ার পরেও তৃণমূল কংগ্রেস কেন প্রতিদ্বন্দ্বিতায় রহিয়াছে, তাহা লইয়া তিনি প্রভূত উষ্মাও প্রকাশ করেন। অতঃপর তৃণমূল কংগ্রেসের মনোনয়ন প্রত্যাহার।
অস্যার্থ, পার্বত্য দার্জিলিঙে এ বারও কোনও নির্বাচন অনুষ্ঠিত হইতেছে না। এবং গোর্খা জনমুক্তি মোর্চার প্রার্থীরা কোনও জনাদেশ ছাড়াই ‘নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি’ ঘোষিত হইয়া জি টি এ-র উপর ন্যস্ত ক্ষমতা ও তহবিলের অধিকারী হইতে চলিয়াছেন। সুবাস ঘিসিং ও তাঁহার জি এন এল এফ-এর সময়েও একই ঘটনা ঘটিয়াছিল। ঘিসিংও জি এন এল এফ ছাড়া অন্য কোনও রাজনৈতিক সংগঠনকে পাহাড়ে অফিস খুলিতে দেন নাই, পতাকা তুলিতে দেন নাই। যত দিন তিনি একচ্ছত্র ক্ষমতার অধিকারী ছিলেন, তত দিন কোনও অবাধ নির্বাচনও পাহাড়ে হইতে দেন নাই। তাঁহারই এক কালের অনুগামী ও অনুরাগীরা বিক্ষুব্ধ ও বীতশ্রদ্ধ হইয়া নূতন সংগঠনের পতাকার নীচে সমাবেশিত হন। সেই সংগঠনই আজকের গোর্খা জনমুক্তি মোর্চা। তাহার নেতা বিমল গুরুঙ্গ ঘিসিংয়ের পদাঙ্কই অনুসরণ করিতেছেন দেখিয়া ইতিহাসের এই পুনরাবৃত্তির মধ্যে প্রহসনের উপাদানও খুঁজিয়া পাওয়া সম্ভব। প্রশ্ন উঠিতেছে, পার্বত্য দার্জিলিঙে কেবল জি এন এল এফ কিংবা জনমুক্তি মোর্চা সক্রিয় থাকিবে, অন্য কোনও রাজনৈতিক সংগঠন ভোটে দাঁড়াইতে পারিবে না, দাঁড়াইলেও তাহার প্রার্থীদের হুমকি দেওয়া হইবে, সামাজিক বয়কট করা হইবে?
তৃণমূল কংগ্রেসের প্রার্থীরা নেতৃত্বের নির্দেশে আপাতত মনোনয়ন প্রত্যাহার করিলেও তাঁহাদের প্রশ্ন এবং ক্ষোভ থাকিতেছেই। নেতৃত্বের তরফে যুক্তি প্রার্থী হইয়া পরাস্ত হইলে নেত্রীর ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণ হইবে। সেটা আবার কেমন কথা? তৃণমূল কংগ্রেস তো দেশের বিভিন্ন রাজ্যের বিধানসভা নির্বাচনেও অনেক আসনে প্রার্থী দিতেছে (ভবিষ্যতেও দিবে), যাহাদের জামানত বাজেয়াপ্ত হইতেছে (ভবিষ্যতেও হইবে)। তাহাতে কি তৃণমূল নেত্রীর ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণ হইতেছে বা হইবে? আসলে তৃণমূল নেতৃত্ব বিমল গুরুঙ্গের সহিত কোনও ঝামেলায় যাইতে নারাজ। ‘পাহাড়ের সমস্যা সমাধান করিয়া ফেলা’র পর পুনরায় সেখানে অশান্তির আগুন জ্বলিয়া উঠুক, বিমল গুরুঙ্গের সৌজন্যে বন্ধ-অবরোধ, হিংসা-সন্ত্রাসের দাবানল ছড়াক, ইহা কেহই চাহে না। প্রশ্ন একটাই শান্তির স্বার্থে তবে গণতন্ত্রকে অনির্দিষ্ট কালের জন্য স্থগিত রাখা হউক? দেশের সর্বত্র নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের হাতে শাসনক্ষমতা থাকিলেও দার্জিলিঙের জনসাধারণকে ভোটপ্রার্থী হওয়ার কিংবা ভোটাধিকার প্রয়োগের অধিকার হইতে বঞ্চিত করা যায়! শান্তির স্বার্থে স্বৈরাচারকে প্রশ্রয় দেওয়া যায়! |