আবেগ মনুষ্যধর্ম। অভিমান বা ক্ষোভ মানুষের অতি জরুরি একটি আবেগ। ইউ পি এ সরকার, বিশেষত তাহার সদ্যপ্রাক্তন অর্থমন্ত্রীর উপর মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ক্ষোভ অহেতুক নহে। তিনি পশ্চিমবঙ্গের জন্য কেন্দ্রের নিকট যে দাবিই পেশ করুন, প্রায় প্রতি বারই তাঁহাকে শূন্য হাতে ফিরিতে হইয়াছে। যে অর্থমন্ত্রী তাঁহাকে বারে বারে হতাশ করিয়াছেন, তাঁহার সহিত শ্রীবন্দ্যোপাধ্যায়ের ব্যক্তিগত সম্পর্কও উষ্ণ বলিয়া মনে করিবার কারণ নাই। কিন্তু ব্যক্তিগত অভিমান যদি রাজনীতির মঞ্চে প্রবেশ করিতে চাহে, তাহার ফল বিষম হয়। শ্রীবন্দ্যোপাধ্যায় প্রণব মুখোপাধ্যায়কে রাষ্ট্রপতি পদে সমর্থন না করিবার যে সিদ্ধান্ত করিয়াছিলেন, তাহা অভিমানসঞ্জাত ভুল সিদ্ধান্ত। অভিমানের বাষ্পে তিনি নিজের রাজনৈতিক শক্তির মাপ বুঝিতে ভুল করিয়াছিলেন। এবং, যাঁহার ভরসায় তিনি এই পথে হাঁটিতে সিদ্ধান্ত করিয়াছিলেন, তাঁহাকে ভরসা করা আরও বড় ভুল। সর্বভারতীয় প্রেক্ষিতে কার্যত একঘরে হইয়া তিনি সেই ভুলের মাসুল চুকাইয়াছেন। আবেগই তাঁহার রাজনীতির অভিজ্ঞান। কিন্তু, অন্তত এই একটি ক্ষেত্রে শ্রীবন্দ্যোপাধ্যায় বুঝিয়াছেন, তাঁহার রাজনীতিকে আবেগের হাত ছাড়িতে হইবে। ভারাক্রান্ত হৃদয়ে হইলেও যে তিনি প্রণব মুখোপাধ্যায়কে সমর্থন করিবার সিদ্ধান্ত করিলেন, তাহা রাজনৈতিক বাস্তববোধের পরিচায়ক।
মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সম্মুখে আর দুইটি পথ ছিল। রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে ভোটদানে বিরত থাকা তাহার মধ্যে প্রথম। তাহাতে তাঁহার ‘জেদ’ রক্ষা পাইত ঠিকই, কিন্তু দিল্লির রাজনীতিতে তিনি দৃশ্যত অপ্রাসঙ্গিক হইয়া পড়িতেন। রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের পাটিগণিত বলিতেছে, তৃণমূল কংগ্রেস সমর্থন করুক আর না-ই করুক, প্রণব মুখোপাধ্যায় রাইসিনা হিলস-এর বাসিন্দা হইতে চলিয়াছেন। এমন অবস্থায় তাঁহাকে সমর্থন না করিলে ক্ষতি প্রণব মুখোপাধ্যায়ের নহে, তৃণমূল কংগ্রেসের। দুই দফা ক্ষতি দলের রাজনৈতিক গুরুত্বহীনতা বিজ্ঞাপিত হওয়া; দিল্লির সঙ্গে সম্পর্কের আরও অবনতি। ব্যক্তিগত অভিমান দূরে সরাইয়া শ্রীবন্দ্যোপাধ্যায় দলের এই ক্ষতি ঠেকাইয়াছেন। বস্তুত, এই সিদ্ধান্তটি ইউ পি এ-র সহিত তাঁহার সম্পর্কের নূতন অধ্যায়ের সূচনালগ্ন হইতে পারে। প্রকাশ কারাট যেমন নূতন অধ্যায়ের মুখবন্ধ করিয়া রাখিয়াছেন। ২০০৮ সালের পরমাণু চুক্তি সংক্রান্ত তিক্ততা তাঁহার এবং কংগ্রেসের মধ্যে যে দূরত্ব রচনা করিয়াছিল, ২০১২ সালে প্রণব মুখোপাধ্যায়কে নিঃশর্তে সমর্থন করিয়া প্রকাশ কারাট তাহার অনেকখানি মুছিয়া ফেলিলেন। তাঁহার ঘরও বাঁচিল যুযুধান পশ্চিমবঙ্গ এবং কেরলের মধ্যে তিনিই যে অনিবার্য যোগসূত্র, তাহা প্রমাণ হইয়া গেল; তাঁহার ভবিষ্যৎও ততখানি অনিশ্চিত থাকিল না।
মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় শুনিলে প্রসন্ন হইবেন না, তবে বর্তমান রাষ্ট্রপতি নির্বাচন তাঁহাকে প্রকাশ কারাটের সহিত একই নৌকার সওয়ারি করিয়াছে। তাঁহার সম্মুখে দ্বিতীয় যে পথটি ছিল, তাহাতে হাঁটা তাঁহার পক্ষে যেমন অসম্ভব, প্রকাশ কারাটের পক্ষেও ঠিক তেমনই। পথটি এন ডি এ-র প্রার্থী-কে সমর্থন করিবার। ভারতে রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের প্রক্রিয়াটি অন্তত দ্বিপাক্ষিক লড়াইয়ের ইউ পি এ বনাম এন ডি এ। এক দলে না থাকিলে অন্য দলে থাকিতেই হইবে। ১৯৮৯ সালে যাহাই হউক, এখন আর প্রকাশ কারাটের পক্ষে বি জে পি-র হাত ধরা সম্ভব নহে। মহাকরণের কথা মাথায় রাখিলে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়েরও অন্য পথ নাই। নরেন্দ্র মোদীর উগ্র হিন্দুত্বের সহিত একাত্ম বোধ না করিলে যে ইউ পি এ ভিন্ন গত্যন্তর নাই, নীতীশ কুমারও তাহাই প্রমাণ করিলেন। অর্থাৎ, এই রাষ্ট্রপতি নির্বাচনকে কেন্দ্র করিয়া জোট হিসাবে ইউ পি এ হঠাৎই উজ্জ্বল হইয়া উঠিল। তাহাতে কংগ্রেসের কৃতিত্ব নাই। রাজনীতির বিভিন্ন স্রোত ইউ পি এ-র মোহনায় মিলিতেছে। রাজনীতি (অ)সম্ভাব্যতার শিল্প। |