বিদ্যুৎ সংস্থাগুলির পিছনে আর বিপুল পরিমাণ ভর্তুকি ঢালতে রাজি নয় কেন্দ্র। আজ সব রাজ্যের বিদ্যুৎমন্ত্রীদের বৈঠকে ডেকে যোজনা কমিশন জানিয়ে দিল, মাসুল বাড়িয়ে এবং উৎপাদনের খরচ কমিয়ে আয় বাড়াতে হবে বিদ্যুৎ সংস্থাগুলিকে। মাসুল না বাড়ালে সরকারি বিদ্যুৎ সংস্থাগুলিকে বাঁচানোর আশা কম বলেই মনে করছে কেন্দ্র।
সস্তায় বিদ্যুৎ দিতে গিয়ে বর্তমানে দেশের বিদ্যুৎ বণ্টন সংস্থাগুলির ঘাড়ে দু’লক্ষ কোটি টাকা ঋণের বোঝা চেপেছে। পরিস্থিতি সামাল দিতে আসরে নামতে বাধ্য হয়েছে কেন্দ্র। যোজনা কমিশনের ডেপুটি চেয়ারম্যান মন্টেক সিংহ অহলুওয়ালিয়া এ দিন বলেন, “মাসুল বাড়িয়ে এবং উৎপাদনের খরচ কমিয়ে ক্ষতিতে রাশ টানার ব্যাপারে গুরুত্ব দিয়ে চিন্তাভাবনা করতে হবে বিভিন্ন রাজ্যের বিদ্যুৎ সংস্থাকে।” বিদ্যুৎ সংস্থাগুলির ঋণের পুনর্গঠন করা হবে বলেও জানিয়েছেন মন্টেক। এই ঋণের পুনর্গঠনের জন্য কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভায় ‘বেল আউট’-এর একটি বিশেষ প্রস্তাব আনতে চলেছে সরকার। কেন্দ্রীয় বিদ্যুৎ মন্ত্রক জানিয়েছে, ওই বেল আউট প্যাকেজে ঋণ পুনর্গঠন এবং বাজারে বন্ড ছাড়ার মতো শর্তের পাশাপাশি আবশ্যিক শর্ত হিসেবে থাকছে বিদ্যুতের মাসুল বাড়ানোর বিষয়টি। আজ কেন্দ্রীয় বিদ্যুৎসচিব পি উমাশঙ্কর বলেন, “আগামী দু’সপ্তাহের মধ্যেই কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভায় ওই প্রস্তাবটি আনার চিন্তা-ভাবনা চলছে। তবে এই সুবিধা সেই রাজ্যগুলিই পাবে, যারা সব শর্ত মানতে রাজি হবে।”
কিন্তু মাসুল বাড়ানোর শর্ত কি মানবে রাজগুলি? বিদ্যুৎ মন্ত্রকের সাফ বক্তব্য, এ ছাড়া অন্য উপায় নেই। কেন না বণ্টন সংস্থাগুলির পক্ষে ভর্তুকি দিয়ে আগামী দিনে বিদ্যুৎ সরবরাহ করা অসম্ভব হয়ে উঠছে।
ডিজেল থেকে সার সব ক্ষেত্রেই কেন্দ্র ধাপে-ধাপে ভর্তুকি তুলে দেওয়ার জন্য সওয়াল শুরু করেছে। প্রধানমন্ত্রীর দুই অর্থনৈতিক উপদেষ্টা কৌশিক বসু এবং সি রঙ্গরাজনও জানিয়ে দিয়েছেন, বিভিন্ন ক্ষেত্রে ভর্তুকি তুলে দিয়ে আর্থিক সংস্কারের পথেই হাঁটতে হবে দেশকে। বিদ্যুতের ক্ষেত্রেও জনমোহিনী পথ ছেড়ে সংস্কারের পথে হাঁটার কথাই বলছে যোজনা কমিশন।
বিদ্যুৎ মন্ত্রকের যুক্তি, সরকারি বিদ্যুৎ সংস্থাগুলি মাসুল না বাড়ালে বেল আউট প্যাকেজ দেওয়া অর্থহীন। কেন না এর আগে ২০০১-০২ সালে বিদ্যুৎ সংস্থাগুলিকে আর্থিক প্যাকেজ দিয়েছিল কেন্দ্র। তাতে সাময়িক ভাবে ঋণের জাল থেকে সংস্থাগুলি রেহাই পেলেও মাসুল না বাড়ায় ফের পুঞ্জীভূত ঋণের জালে জড়িয়ে পড়ে। এই পরিস্থিতিতে রুগ্ণ সংস্থাগুলিকে বাঁচাতে বিশেষ প্যাকেজ দেওয়া ছাড়া বিকল্প রাস্তা নেই বলে বক্তব্য মন্ত্রকের।
মাসুল সংশোধন না করায় প্রায় রুগ্ন বিদ্যুৎ বণ্টন সংস্থাগুলিকে আর ঋণ দিতে চাইছে না ব্যাঙ্ক এবং আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলি। নতুন বিদ্যুৎ প্রকল্পগুলিতেও তারা টাকা ঢালতে রাজি হচ্ছে না। বহু সরকারি বিদ্যুৎ সংস্থাই ঋণের জন্য ব্যাঙ্কের দরজায়-দরজায় ঘুরছে। ফলে বিদ্যুৎ শিল্পে বিপুল পুঁজির অভাব দেখা দিয়েছে। আর্থিক সংস্থাগুলি জানিয়ে দিয়েছে, মাসুল বাড়িয়ে আয় না বাড়ালে ঋণ দেওয়ার ঝুঁকি নেওয়া যাবে না।
মাঝে এই সমস্যায় পড়েছিল পশ্চিমবঙ্গের বিদ্যুৎ বণ্টন সংস্থাও। ক্ষমতায় এসে মমতা-সরকার বিদ্যুতের মাসুল বাড়াতে দিতে রাজি না হওয়ায় বিপুল ঋণের বোঝা চাপে সংস্থাটির উপরে। ব্যাঙ্কগুলিও ওই সময় জানিয়ে দেয়, মাসুল সংশোধন না করলে তারা এক টাকাও ঋণ দেবে না। গ্রীষ্মের আগে পরিস্থিতি এমন জায়গায় গিয়ে দাঁড়ায় যে, বণ্টন সংস্থা জানিয়ে দেয়, সরকার মাসুল বাড়াতে না দিলে রাজ্য জুড়ে দিনে ১২-১৪ ঘণ্টা লোডশেডিং শুরু হবে। বিপদ বুঝে পরে ঘুরপথে বিদ্যুতের মাসুল বাড়াতে দিতে রাজি হয় মমতা-সরকার।
বিদ্যুৎ মন্ত্রক সূত্রের খবর, বিদ্যুৎ ক্ষেত্রে তামিলনাড়ুর ঋণের পরিমাণ প্রায় ৫০ হাজার কোটি টাকা। রাজস্থান ও উত্তরপ্রদেশের মোট ঋণ ৮০ হাজার কোটি টাকার কাছাকাছি। যোজনা কমিশনের এক কর্তা জানিয়েছেন, ঋণের বোঝা সামলাতে না পেরে মাসুল বাড়াতে বাধ্য হয়েছে কয়েকটি রাজ্য। সম্প্রতি তামিলনাড়ুর মুখ্যমন্ত্রী জয়ললিতা তাঁর রাজ্যে বিদ্যুতের মাসুল বাড়াতে বাধ্য হয়েছেন। গত দেড় বছরে দিল্লি সরকারও একাধিক বার বিদ্যুতের দাম বাড়িয়েছে বলে ওই কর্তা জানান। পশ্চিমবঙ্গের বিদ্যুৎ সংস্থাগুলির ঘাড়ে তামিলনাড়ু, উত্তরপ্রদেশের মতো বিপুল ঋণের বোঝা নেই বলেই দাবি রাজ্যের বিদ্যুৎ কর্তাদের। কারণ তাঁরা এখন উৎপাদন খরচের সঙ্গে তাল মিলিয়ে প্রতি ইউনিট বিদ্যুতের দাম বাড়াতে পারছে।
বিদ্যুৎ মন্ত্রক সূত্রে জানা গিয়েছে, ঋণের বোঝা কমাতে তিনটি সম্ভাব্য পদ্ধতি নিয়ে চিন্তাভাবনা করছে মন্ত্রক। প্রাথমিক ভাবে ঠিক হয়েছে, পুঞ্জীভূত ঋণের অর্ধেক অংশের সমপরিমাণ বন্ড বাজারে ছাড়বে সংশ্লিষ্ট রাজ্য সরকার। বাকি ঋণ ব্যাঙ্কগুলি পুনর্গঠন করবে। পাশাপাশি বণ্টন সংস্থাগুলিকে আগামী তিন বছরের জন্য ঋণের আসল দেওয়া থেকে রেহাই দেওয়ার কথাও ভাবা হচ্ছে। যাতে ওই সময়ের মধ্যে সংস্থাগুলি নিজেদের আর্থিক অবস্থা গুছিয়ে নেওয়ার সুযোগ পায়। যোজনা কমিশন চাইছে, কেন্দ্রীয় সাহায্যের পাশাপাশি ব্যাঙ্ক এবং রাজ্য সরকারগুলি এই সমস্যা মেটাতে সাহায্য করুক। |