রাস্তার উপর দিয়ে বয়ে চলেছে হাঁটু জল। রান্না ঘরের উনুন জলের তলায় চলে গিয়েছে। শোওয়ার ঘরেও জলে থইথই করছে। খানিকটা উঁচু জায়গায় খাট পেতে তাতেই আশ্রয় নিয়েছেন বাসিন্দারা। জলের তোড়ে ভেঙে পড়েছে শিশু শিক্ষা কেন্দ্র রবিবার রাতে কারও উনুনই আগুন জ্বলেনি। চোখের দু’পাতাও একখানে করতে পারেনি পরিবারের শিশু থেকে বৃদ্ধ কেউই। একদৃষ্টিতে জলের দিকে তাকিয়ে শুধু অপেক্ষা করেছেন ভোরের। মিলন মোড়ে তখন বাসিন্দাদের উদ্ধারের জন্য ঝাঁপিয়েছেন প্রশাসন থেকে স্বেচ্ছাসেবী দলের কর্মীরা। কিন্তু শিলিগুড়ি সংলগ্ন উত্তর সমরনগরের খবর পৌঁছয়নি কারও কাছে। সোমবার ভোর হতেই উঁচু জায়গায় আশ্রয় নেন বাসিন্দারা। এলাকার নেতাদের দ্বারস্থ হন তাঁরা। দুপুর ১২টা নাগাদ উত্তরবঙ্গ উন্নয়ন মন্ত্রী গৌতম দেব যান ওই গ্রামে। বাসিন্দাদের অবস্থা আঁচ করতে পেরে হাঁটু জলে নেমে গোটা এলাকা ঘুরে দেখেন তিনি। বাসিন্দাদের আশ্বস্ত করে বলেন, “আমি আপনাদের পাশে আছি।” জেলাশাসককে ফোন করে বলেন, উত্তর সমরনগরের বাসিন্দাদের জন্যও যেন ত্রাণের ব্যবস্থা করা হয়। গৌতমবাবু বলেন, “এলাকার মানুষ খুব অসুবিধেয় আছেন। নিকাশির কোনও ব্যবস্থা না থাকায় জল এলাকা থেকে বেরোতে পারছে না। বাস্তুকারের সঙ্গে কথা বলে পরিকল্পিত নিকাশির ব্যবস্থা করা হবে। পাশাপাশি বাসিন্দাদের ত্রাণের ব্যবস্থা করা হয়েছে।” তিনি জানান, গোটা বিষয়টি মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যেপাধ্যায়কে ইতিমধ্যে জানিয়েছেন তিনি। প্রয়োজনে ফের তাঁর সঙ্গে কথা বলবেন। গৌতমবাবু ফুলবাড়ি এলাকাতে গিয়ে মহানন্দা ব্যারেজের ইঞ্জিনিয়ারদের সঙ্গে বৈঠক করেন। তিনি এনজেপিতে ডিএস কলোনিতেও যান। মন্ত্রী বলেন, “পশ্চিম ধনতলা থেকে জল বেরনোর রাস্তা না থাকার জন্যই বন্যা হচ্ছে। বাস্তুকারদের সঙ্গে বৈঠক করেছি। সেচমন্ত্রী এসেছেন। তাঁর সঙ্গে কথা বলব। মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গেও কথা বলব। যাতে ওই এলাকাগুলিতে বন্যা না হয় সে জন্য পরিকল্পিত ব্যবস্থা নেওয়া হবে।” |
নদীর চরে যাতে কেউ বাড়ি না করেন সে ব্যাপারেও মন্ত্রী সতর্ক করে দেন। মন্ত্রী বলেন, “অনেকে টাকা নিয়ে নদীর চরে বসতি গড়ে তোলার চেষ্টা করছে। আমরা বিষয়টি দেখছি। এরকম প্রমাণ পেলে আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া হবে।” এদিন ওই গ্রামে গিয়ে দেখা যায়, নিজের বাড়ির একটি উঁচু জায়গায় দাঁড়িয়ে আছেন পূর্ণিমা মণ্ডল। হাঁটু জলে দাঁড়িয়ে আছেন তাঁর স্বামী গোপালবাবু। মন্ত্রীর আসার কথা শুনে কিছু বলবেন বলে দাঁড়িয়ে আছেন। পূর্ণিমা দেবী বলেন, “সন্ধ্যার পর থেকেই গ্রামে জল ঢুকতে শুরু করে। রান্না ঘরে জল ঢুকে যায়। আর রান্না করতে পারিনি। শোওয়ার ঘরে জল ঢুকে যাওয়ায় আমরা বিছানার উপরে উঠে যাই। জল কমবে এই আশায় সেখানেই বসে থাকি সারা রাত। আবার ভয় হয়, আরও জল যদি বেড়ে যায় তাহলে কি করব। রাতে কোথাও যাওয়ার জায়গাও ছিল না।” গাড়ির চালক শ্যামল সরকার কাজ সেরে বাড়ি ফিরছিলেন। দেখেন সারা গ্রামে জল ঢুকেছে। দ্রুত বাড়ির উদ্দেশে পা বাড়ান তিনি। তিনি বলেন, “বাড়ির কাছে পৌঁছে দেখে ছেলেমেয়ে, স্ত্রী সবাই জলের মধ্যে দাঁড়িয়ে আমার জন্য অপেক্ষা করছেন। রান্না করতে পারেননি। ওই অবস্থা দেখে খিদে ভুলে গিয়েছি। সবাইকে নিয়ে রাতে কি থাকব তা নিয়ে ভাবতে থাকি। আমাদের এখানে প্রশাসন বা পঞ্চায়েতের কেউ আসেনি। পরে বিছানার উপরে সকলকে নিয়ে রাত কাটাই। এখনও জল নামেনি।” এলাকার বাসিন্দা উপেন্দ্রনাথ রায়, প্রদীপ বিশ্বাসরা জানান, ওই গ্রামে এর আগে কখনও এতটা জল জমেনি। বৃষ্টির সামান্য জল হলেও তা নেমে গিয়েছে। ওই দিন সন্ধ্যার পরে জলের এতটাই গতি ছিল যে উত্তর সমরনগর শিশু শিক্ষা কেন্দ্রটি ভেঙে পড়ে। দার্জিলিংয়ের জেলাশাসক সৌমিত্র মোহন বলেন, “ওই এলাকা জলপাইগুড়ি জেলার মধ্যে পড়ে। ওই জেলাশাসকের সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়েছে। ত্রাণের ব্যবস্থা করা হচ্ছে।” এদিকে, রবিবার রাতভর মিলন মোড় লাগায়ো বিভিন্ন এলাকায় উদ্ধার কাজ চালায় হিমালয়ান নেচার অ্যান্ড ফাউন্ডেশনের কর্মীরা। স্থানীয় যুবকরাও ওই কাজে সহযোগিতা করেন। প্রশাসনের পক্ষ থেকে জেলাশাসক সৌমিত্র মোহন রাত ২টা জেগে ‘মনিটরিং’ করেন। প্রায় ৩০ জন শিশু-মহিলাকে উদ্ধার করে নিরাপদ আশ্রয়ে নিয়ে যাওয়া হয়। ন্যাফের মুখপাত্র অনিমেষ বসু বলেন, “আমরা স্থানীয় যুবকদের নিয়ে গিয়ে তাঁদের উদ্ধার করি।’’ ফুলবাড়ি এলাকায় প্রচুর মানুষ বাঁধের উপরে আশ্রয় নিয়ে রাত কাটিয়েছেন। |