ভেজা কাপড়ে বাঁধে গুটিসুটি হয়ে বসে ঠকঠক করে কাঁপছিলেন সত্তরোর্ধ্ব দেবেশ্বরী রায়। অপলক দৃষ্টিতে দূরে তাকিয়ে তিনি। বাড়ির টিনের চাল ছুঁয়েছে জল। আর কিছুটা বাড়লে উধাও হয়ে যাবে বর্মন পাড়া। বাঁধে বসে তিনি যেন সময় গুনছেন। শনিবার রাত থেকে উত্তাল তিস্তা। জল বেড়ে একে একে ভেসেছে ময়নাগুড়ির দোমহনি-১ গ্রাম পঞ্চায়েতের অধীন বর্মনপাড়া, সরকারপাড়া, দাসপাড়া ও চাতরারপাড়া এলাকা। দেবেশ্বরী দেবীদের কাছে বানভাসি হওয়াটা নতুন কিছু নয়। নদীর চরে বাড়ি। তাই ফি বছর নদীকে তাঁরা গর্জে উঠতে দেখে অভ্যস্ত। কিন্তু এ বার তিস্তার রুদ্র মূর্তি দেখে অবাক হয়েছেন বৃদ্ধার মতো অনেকে। একই কথা ফিরছে বানভাসিদের মুখেমুখে গত কয়েক বছরে নদীকে এ ভাবে ফুঁসে উঠতে কেউ দেখেনি। ক্রমশ জল বাড়তে দেখে রবিবার অন্তত দেড়শো পরিবার বাসনপত্র, গবাদি পশু, বিভিন্ন সামগ্রী নিয়ে বাঁধে আশ্রয় নিয়েছেন। তাঁদের ধারণা ছিল কয়েকঘন্টা পড়ে জল নামলে ফিরে যাবেন। প্রতিবছর তিস্তায় এমনটাই হয়ে আসছে। কিন্তু কোথায় কী! সময় যত গড়িয়েছে নদী তত উত্তাল হয়েছে। পাক খেয়ে পাহাড়ি নদীর ঘোলা জল আছড়ে পড়েছে বাঁধের গায়ে। চর এলাকায় গড়ে ওঠা টিনের বাড়িগুলি একেএকে জলে তলিয়েছে। দোমহনি-১ গ্রাম পঞ্চায়েত প্রধান জিতেন সরকার বলেন, “কিছু সময় থমকে থাকার পরে ফের নদীর জল বাড়ছে। তিস্তাকে এ ভাবে ফুলেফেঁপে উঠতে এর আগে দেখিনি।” গ্রাম পঞ্চায়েতের তরফে শুকনো খাবার ও খিচুড়ির ব্যবস্থা করা হলেও তা দিয়ে খিদে মিটছে কোথায়! খাবারের জন্য শিশুরা পলিথিনের আস্তানার তলায় বসে কাঁদছে। ময়নাগুড়ি ব্লক তৃণমূল সম্পাদক গোবিন্দ পাল সকাল থেকে দুর্গত এলাকার এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে ঘুরে ত্রাণ পৌঁছে দেওয়ার কাজে তদারকি করেছেন। আরও খিচুড়ি রান্না করে তা বিলিয়েছেন। তিনি বলেন, “নদীর জল যে ভাবে বাড়ছে ভয় করছে।” পাহাড়ি কন্যার রুদ্র মূর্তি দেখে অতঙ্কিত বার্নিশ গ্রাম পঞ্চায়েত এলাকার বাসিন্দারা। ১৯৬৮ সালে কেমন করে ওই নদী জনপদ গ্রাস করেছিল তা আজও ভোলেননি যোগেন রায়ের মতো স্থানীয় প্রবীণ বাসিন্দারা। জল বাড়ছে শুনে সকাল থেকে ঠায় দাঁড়িয়ে তাঁর মতো অনেকে শান্ত হওয়ার আকুতি নিয়ে ‘তিস্তাবুড়ি’ নামে নদীকে পুজো দিয়েছেন। স্থানীয় গ্রাম পঞ্চায়েত প্রধান অতীন্দ্রনাথ রায় বলেন, “এলাকার ২০টি পরিবার বাঁধে আশ্রয় নিয়েছে।” তিস্তার বাহির চর, মোতিয়ার চর এলাকা কয়েক বছরে শস্য ভাণ্ডার নামে পরিচিতি পেয়েছে। এখান থেকে শাক ও সবজি হলদিবাড়ি হয়ে পৌছে যায় শিলিগুড়ির বাজারে। সামনে পুজো। এ বারও এলাকার বাসিন্দারা আগাম সবজির চাষ শুরু করেছিলেন। কিন্তু শনিবার রাত থেকে সবই তলিয়েছে। সোমবার বিডিও কল্যাণ বড়ুয়া মতিয়ার চর যান। এখানে নৌকায় উদ্ধার কাজ চলে। বিডিও বলেন, ‘‘ত্রাণ সমস্যা নেই। পলিথিন পাঠানো হয়েছে। খিচুড়ি বিলি হচ্ছে।” |