|
|
|
|
আপত্তি সরকারের |
সিঙ্গুর নিয়ে রাজ্যপালের ‘মধ্যস্থতা’ চায় কংগ্রেস |
নিজস্ব সংবাদদাতা • কলকাতা |
চার বছর আগের সিঙ্গুরে বিরোধী নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ধর্না-অবস্থান চলাকালীন সমস্যা সমাধানে উদ্যোগী হয়েছিলেন তৎকালীন রাজ্যপাল গোপালকৃষ্ণ গাঁধী। সেই সিঙ্গুরেরই ‘জট’ ছাড়াতে এ বার বর্তমান রাজ্যপাল এম কে নারায়ণনের কাছে ‘মধ্যস্থতা’র প্রস্তাব এল। প্রস্তাব দিল সরকারের শরিক কংগ্রেস। এবং প্রায় পত্রপাঠ তাতে আপত্তি জানাল প্রধান শাসক দল তৃণমূল। ফলে, সিঙ্গুর-সমস্যা রয়ে গেল জট-বন্দিই।
রাজ্যপালের সঙ্গে দেখা করে সোমবার প্রদেশ কংগ্রেসের একটি প্রতিনিধিদল তাঁর কাছে অনুরোধ জানিয়েছে, সিঙ্গুরের কৃষক, টাটা গোষ্ঠী এবং সরকার পক্ষ-সহ সব রাজনৈতিক দলকে একসঙ্গে নিয়ে আলোচনায় বসুন তিনি। আইনি লড়াইয়ের বাইরে একটি মীমাংসাসূত্র বার করতে রাজ্যপালকে উদ্যোগী হতে অনুরোধ করেছেন প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি প্রদীপ ভট্টাচার্য। মমতার সরকারের সিঙ্গুর আইন কলকাতা হাইকোর্টে খারিজ হয়ে যাওয়ার পরে দীর্ঘ আইনি লড়াইয়ে সিঙ্গুর-সমস্যার সমাধান ক্রমেই সুদূরপরাহত হয়ে উঠছে বলেই কংগ্রেসের এমন আবেদন।
তবে সরকারের শরিক কংগ্রেস এমন প্রস্তাব দিলেও রাজ্য সরকারের তরফে তাতে ‘ইতিবাচক’ কোনও সাড়া মেলেনি। শিল্পমন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায় কংগ্রেসের প্রস্তাবকে ‘গুরুত্ব’ দিতে চাননি। তাঁর বক্তব্য, গোপালকৃষ্ণের ‘মধ্যস্থতা’য় বেরিয়ে-আসা মীমাংসাসূত্র যেখানে তৎকালীন বামফ্রন্ট সরকার মানেনি, আর কোনও রাজ্যপাল তা হলে এই বিষয়ে উদ্যোগী হতে যাবেন কেন? প্রধান বিরোধী দল সিপিএম-ও কংগ্রেসের প্রস্তাবে তেমন ‘উৎসাহিত’ নয়। তাদের মত, আদালতের বাইরে সমাধানসূত্র বার করার জন্য প্রথম বসতে হবে রাজ্য সরকার এবং টাটা গোষ্ঠীকেই। বাকিদের ভূমিকা পরে।
রাজ্যপালের সঙ্গে সাক্ষাতের পরে প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি প্রদীপবাবু এ দিন বলেন, “রাজ্যপালকে চেয়ারম্যান করে কৃষক, টাটা গোষ্ঠী, সরকার-সহ রাজনৈতিক দলগুলিকে নিয়ে ত্রিপাক্ষিক একটি কমিটি গড়ার প্রস্তাব দিয়েছি আমরা।” সিঙ্গুর আইন নিয়ে হাইকোর্টের সাম্প্রতিক রায়ের প্রেক্ষিতে সিঙ্গুরের জমি ফেরত যে ‘সময়সাপেক্ষ’, তা-ও প্রদীপবাবুরা এ দিন রাজ্যপালকে বুঝিয়েছেন। জমি ফিরিয়ে দিতে রাজ্য সরকারের প্রতিশ্রুতি পালনে ‘বিলম্বে’ সিঙ্গুরের কৃষকদের ধৈর্য্যচ্যুতির আশঙ্কা রয়েছে বলেও তাঁরা রাজ্যপালকে জানিয়েছেন। এই প্রেক্ষিতে মুখ্যমন্ত্রী মমতাকে বুঝিয়ে আলোচনার টেবিলে আনার জন্য রাজ্যপালকে ‘তৎপর’ হতে অনুরোধ করেছেন কংগ্রেস নেতারা। সিঙ্গুর-কাণ্ডের পরে এ রাজ্যে শিল্পপতিরা আসতে আগ্রহী হচ্ছেন না বলেও রাজ্যপালের কাছে ‘উদ্বেগ’ প্রকাশ করেন প্রদীপবাবুরা। পাশাপাশিই, সিঙ্গুরে ‘অনিচ্ছুক’দের দু’হাজার টাকা করে যে অনুদান দেওয়া হচ্ছে, তার প্রাপকদের তালিকায় ‘অস্বচ্ছতা ও বিভ্রান্তি’ রয়েছে বলে রাজ্যপালের কাছে অভিযোগ করেছেন বর্ষীয়ান কংগ্রেস নেতা আব্দুল মান্নান। পরে মান্নান বলেন, “অনুদানপ্রাপকদের তালিকা চাইলে বিডিও তা দিতে পারছেন না। খেতমজুর, বর্গাদার, অনিচ্ছুক কৃষকের নামে সরকার যে অনুদান দিচ্ছে, প্রকৃত দাবিদাররাই তা পাচ্ছেন কি না, তা খতিয়ে দেখতে উদ্যোগী হতে রাজ্যপালকে অনুরোধ করেছি।”
জোট শরিকের প্রস্তাবের প্রেক্ষিতে শিল্পমন্ত্রী পার্থবাবুর মত, আইনি লড়াইয়ের বাইরে রাজ্যপালের ‘হস্তক্ষেপ’ কার্যত অর্থহীন। তাঁর কথায়, “তদানীন্তন রাজ্যপাল গোপালকৃষ্ণ গাঁধী মধ্যস্থতা করে সিঙ্গুর চুক্তি সই করিয়েছিলেন। কিন্তু তখন তো বাম সরকার সেই চুক্তি মানেনি। ফলে, এখন আবার কোন রাজ্যপাল সিঙ্গুর নিয়ে মধ্যস্থতায় এগিয়ে আসবেন?” এই সূত্রে কংগ্রেসকে পাল্টা আক্রমণও করেছেন পার্থবাবু। তাঁর বক্তব্য, “প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংহ মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে অনুরোধ করেছিলেন সিঙ্গুর নিয়ে অনশন তুলে নিতে। বলেছিলেন, আলোচনার মাধ্যমে সিঙ্গুর সমস্যা মিটে যাবে। কিন্তু তার পরে কেন্দ্রীয় সরকার তো আর কোনও পদক্ষেপ করেনি!” সিঙ্গুর আন্দোলনের সময় কৃষক স্বার্থে কেন্দ্রের কংগ্রেস নেতৃত্ব সামিল হননি বলেও অভিযোগ শিল্পমন্ত্রীর। তাঁর কটাক্ষ, “একমাত্র প্রিয়রঞ্জন দাশমুন্সি এক বার এসেছিলেন অনশন-মঞ্চে। কেন্দ্রের আর কোনও নেতাকে তো দেখা যায়নি তখন! এখন কংগ্রেস নেতারা রাজ্যপালের ছাতার তলায় আসতে চাইছেন কেন, বুঝছি না! সিঙ্গুর নিয়ে কংগ্রেসের কুম্ভীরাশ্রু ফেলার কোনও মানে হয় না!”
কংগ্রেসের প্রস্তাবের প্রতিক্রিয়ায় বিরোধী দলনেতা সূর্যকান্ত মিশ্র বলছেন, “মামলার দু’টো পক্ষ টাটা এবং রাজ্য সরকার। সমাধান কিছু বার করতে গেলে তাদেরই আগে আলোচনায় বসতে হবে। বাকি কেউ তো মামলার পক্ষ নয়।” সিপিএমের পলিটব্যুরো সদস্য সুর্যবাবুর মতে, টাটা-সরকার আলোচনা বা সমাধানসূত্রকে কেন্দ্র করে সর্বদল বৈঠক ডাকা যেতে পারে। কিন্তু সংশ্লিষ্ট সবাই একসঙ্গে সমাধানসূত্র বার করতে বসবেন এটা খুব একটা কাজের কথা নয়।
সিঙ্গুর কৃষিজমি রক্ষা কমিটির আহ্বায়ক তথা হরিপালের তৃণমূল বিধায়ক বেচারাম মান্নাও প্রশ্ন তুলেছেন কংগ্রেসের প্রস্তাবের ‘যৌক্তিকতা’ নিয়ে। তাঁর বক্তব্য, “যাঁরা এ কথা বলছেন, তাঁরা কি জানেন না যে, পুরো বিষয়টি এখনও আদালতের বিবেচ্য! এই ব্যাপারে আদালতের বাইরে কারও সিদ্ধান্ত নেওয়ার জায়গা নেই। যদি তা থাকত, তবে
চাষিদের জন্য রাজ্য সরকারই তা করত। অন্য কারও মধ্যস্থতার দরকার হত না।” বেচারামের আরও কটাক্ষ, “আসলে পরিস্থিতির সুযোগ নিয়ে কোনও কোনও রাজনৈতিক দল ঘোলা জলে মাছ ধরতে চাইছে! চাষিদের পাশে কারা আছে, সবাই তা জানে। লোক দেখানো আন্দোলনে সত্য বদলায় না!” |
|
|
|
|
|