সরকারের উদ্দেশ্য শিল্প স্থাপন করা। দুবরাজপুরের লোবা অঞ্চলে প্রস্তাবিত খোলামুখ কয়লাখনির যাঁরা যে শর্তে জমি দিয়েছেন সেটা প্রতিপালন করা সরকারের দায়িত্ব। সোমবার এ কথা বলেন শিল্পমন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায়। তিনি এ দিন ওই কয়লাখনির জন্য জমি নেওয়াকে ঘিরে তৈরি হওয়া জট কাটাতে লোবায় আসেন। সব পক্ষ নিয়ে বৈঠক শেষে পার্থবাবু খনি নির্মাণকারী ডিভিসি-এমটাকে তাদের পূর্ণাঙ্গ পরিকল্পনা (জমি ক্রয় থেকে পুনর্বাসন প্যাকেজ) ৭ দিনের মধ্যে স্থানীয় পঞ্চায়েত থেকে জেলা প্রশাসনের কাছে লিখিত দিতে বলেছেন। তিনি বলেন, “শিল্প জরুরি। তবে রাজ্য সরকার এমন কিছু করবে না যা জনস্বার্থ ক্ষুণ্ণ করে।”
কীসের জট?
প্রশাসন ও স্থানীয় সূত্র অনুযায়ী, ওই খোলামুখ কয়লা খনি গড়ে তুলতে লোবা পঞ্চায়েত এলাকার লোবা-সহ ১০টি মৌজার মোট ৩,৩৫৩ একর জমি কেনার কথা ছিল ডিভিসি-এমটার। এর মধ্যে ২২৩২ একর জমি শুধুমাত্র খনির জন্য, বাকিটা পুনর্বাসন-সহ অন্য কাজে ব্যবহারের জন্য রাখার কথা। গোটা প্রকল্পের উদ্দেশ্য, ডিভিসি পরিচালিত দুর্গাপুর ও মেজিয়া তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রের জন্য কয়লা সরবরাহ করা। সে জন্য বছরখানেক আগে থেকে এলাকার জমির মালিকদের কাছ থেকে সরাসরি জমি কেনাও শুরু করেছিল। ওই সংস্থা কর্তৃপক্ষ জমি কেনার ‘পদ্ধতি’ নিয়ে আপত্তি তুলে গত বছর ডিসেম্বর মাস থেকে ডিভিসি-এমটা কোল মাইনস লিমিটেডের মাটি কাটার যন্ত্র আটকে রেখেছেন স্থানীয় বাসিন্দাদের একাংশ এবং কৃষিজমি রক্ষা কমিটির সদস্যরা। প্রশাসনিক স্তরে বহু চেষ্টা করা হলেও সেই যন্ত্রটি আন্দলোনকারীরা ছাড়েননি এবং খনির কাজ একচুলও এগোয়নি। |
কৃষিজমি রক্ষা কমিটির অভিযোগ, এলাকার মানুষের সঙ্গে আলোচনা না করেই কাজ শুরু করেছিল ওই সংস্থা এবং সংস্থার ‘প্রতিশ্রুতি’ অনুযায়ী একলপ্তে এলাকার সব জমি কেনার কথা থাকলেও বাস্তবে ওই সংস্থা দু’-চারটি মৌজায় বিক্ষিপ্ত ভাবে কিছু জমি কিনে কয়লা খনির জন্য খননকাজ শুরু করতে চেয়ছিল। শুধু তাই নয় অধিকাংশ কৃষিজীবী, দিনমজুর, খেতমজুর, বর্গাদার বা পাট্টাদার-সহ এলাকার অধিকাংশ মানুষকে ‘অন্ধকারে’ রেখে কিছু মধ্যস্থতাকারী মারফত জমি কেনা হচ্ছিল। কৃষিজমি রক্ষা কমিটির পক্ষে জয়দীপ মজুমদার ও ফেলারাম মণ্ডলদের দাবি, “জমিহারা ক্ষুদ্র চাষি, অনথিভুক্ত জমির মালিক, বর্গাদার, পাট্টাদার বা খেতমজুরদের ভবিষ্যৎ কী হবে, তার কোনও স্পষ্ট রূপরেখা অর্থাৎ উপযুক্ত ক্ষতিপূরণ ও পুনর্বাসন প্যাকেজ স্থির না করেই কাজ শুরু করার প্রতিবাদেই মাটি কাটার যন্ত্র আটকে রাখেছেন গ্রামের মানুষ।” তাঁরা বলেন, “আমরা শিল্পের বিপক্ষে নই।”
অন্য দিকে, খোলামুখ কয়লাখনি গড়তে আসা সংস্থা অবশ্য কৃষিজমি রক্ষা কমিটি অভিযোগ মানতে নারাজ। সংস্থার দাবি, ইতিমধ্যেই ৭০০ একর জমি কেনা হয়েছে এবং তৎকালীন জেলাশাসক, সংস্থার আধিকারিক, জনপ্রতিনিধি, রাজনৈতিক দলের নেতা, এলাকাবাসী এবং স্থানীয় পঞ্চায়েত প্রধানের উপস্থিতিতেই জমির দাম ও পুনর্বাসন প্যাকেজ ঘোষিত হয়েছিল। যা কিছু করা হয়েছে, ওই বৈঠকের সিদ্ধান্ত মেনেই। এখানে অস্বচ্ছতা বা সাধারণ মানুষকে অন্ধকারে রাখার প্রশ্নই নেই।
এই জমি জট কাটাতে এ দিন প্রথমে লোবা পঞ্চায়েতে বৈঠক করেন শিল্পমন্ত্রী। পরে স্থানীয় বাসিন্দা ও কৃষিজীবীদের সঙ্গে কথা বলেন তিনি। উপস্থিত ছিলেন কৃষিজমি রক্ষা কমিটির সদস্যরা, কয়লাখনি গড়তে আসা ‘পাবলিক-প্রাইভেট পার্টনারশিপ’ বা পিপিপি ভিত্তিতে গড়ে ওঠা ডিভিসি-এমটা কোল মাইনস লিমিটেডের প্রতিনিধিবর্গ, জেলার মন্ত্রী চন্দ্রনাথ সিংহ, তৃণমূলের জেলা সভাপতি অনুব্রত মণ্ডল, জেলাশাসক জগদীশপ্রসাদ মিনা, পুলিশ সুপার হৃষিকেশ মিনা প্রমুখ। জমির দরদামের ব্যাপারে রাজ্য সরকার মধ্যস্ততা করবে না জানিয়ে শিল্পমন্ত্রী আন্দলোনকারীদের সংস্থার মাটি কাটার যন্ত্রটিকে ছেড়ে দেওয়ার অনুরোধও করেন। এতেই অর্ধেক সমস্যা মিটবে বলে তাঁর আশা। খনি নির্মাণকারী সংস্থার জয়দেব-খাগড়া প্রকল্পের চিফ জেনারেল ম্যানেজার আর আর কিশোর বলেন, “আমাদের সব কাগজপত্র তৈরি। মন্ত্রীর নির্দেশ মেনে শীঘ্রই প্রশাসনের কাছে জমা দেব।” কৃষিজমি রক্ষা কমিটির পক্ষে জয়দীপ মজুমদার ও ফেলারাম মণ্ডলদের কথায়, “শিল্পমন্ত্রী আমাদের কথা শুনেছেন। আমরা কৃতজ্ঞ। তবে বাস্তবে ঠিক কী ধরনের পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে সেটা দেখতে হবে। সকলের সঙ্গে কথা বলে মাটি কাটার যন্ত্রটিকে ছেড়ে দেওয়ার ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেব।” |