শিয়রে শমন/২
জীবাণুকে দূরে রাখার দাওয়াই
বহু, মানছে কে

দৃশ্য ১:
সকাল সাতটা। সল্টলেকের এক বেসরকারি হাসপাতালের সাততলা।
আইটিইউয়ের সামনে, লিফ্টের অদূরে মুখঢাকা দু’টো ডাস্টবিন উপচে পড়ছে মেডিক্যাল বর্জ্যে। ক’জোড়া চটি-জুতো ছড়ানো। ইতিমধ্যে লন্ড্রি থেকে উঠে এল গাঁটরিবোঝাই কাচা কাপড় রোগীদের গাউন, বিছানার চাদর ইত্যাদি। লন্ড্রির লোক লিফ্টের বাইরে গাঁটরিগুলো নামিয়ে দায় সারলেন। ডাস্টবিনের গা ঘেঁষে, ধুলোর উপরে ঘণ্টাখানেক ফেলে থাকার পরে ওয়ার্ড-কর্মীরা সেগুলো ভিতরে নিয়ে গেলেন। জানা গেল, এটাই রোজকার ছবি।
দৃশ্য ২: বাইপাসের এক বেসরকারি হাসপাতালে ভিজিটিং আওয়ার্স। পরিজনেরা আইসিইউয়ের বাইরে জুতো রেখে ভিতরে ঢুকছেন। এক চিকিৎসক জুতো পরেই ঢুকে গেলেন! ওঁরা প্রশ্ন তুলতে পারতেন, ডাক্তারের জুতোয় কি ধুলো থাকে না?
দৃশ্য ৩: সল্টলেকের এক বেসরকারি হাসপাতালের আইসিইউ। এক জনের জ্বর মেপে থার্মোমিটার না-ধুয়েই পাশের জনের মুখে প্রায় দিয়ে ফেলেছিলেন নার্স! আর এক রোগী চেঁচিয়ে ওঠায় থমকে যান। ওঁকে এক সপ্তাহ সাসপেন্ড করা হয়। এই ‘ভুল’ যে আগে-পরে হয়নি বা হচ্ছে না, গ্যারান্টি কোথায়?
অথচ বিশ্ব জুড়ে ‘হসপিটাল অ্যাকোয়ার্ড ইনফেকশন’ যত বাড়ছে, সমস্ত স্তরের স্বাস্থ্যকর্মীদের পরিচ্ছন্নতা এবং ওয়ার্ডকে নিয়মিত সংক্রমণমুক্ত রাখার প্রক্রিয়াগুলো তত গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠছে। কী রকম?
এ দেশে হাসপাতালের সংক্রমণ নিয়ে কাজ করে যে সংস্থা, সেই ‘হসপিটাল ইনফেকশন সোসাইটি অফ ইন্ডিয়া’র সদস্যেরা জানিয়েছেন, হাসপাতালকর্মীরা নির্দিষ্ট সময় অন্তর হাত ধুলে, জীবাণুমুক্ত গাউন-গ্লাভস পরলে, রোগীর পোশাক-বিছানার চাদর পরিষ্কার রাখলে আশঙ্কা অনেক কমে। ওঁরা বলছেন, আইসিইউ-আইটিইউয়ে ঢোকার আগে প্রত্যেককে হ্যান্ড স্যানিটাইজার ব্যবহারে বাধ্য করতে হবে। দেখতে হবে, বাড়ির লোকও যেন রোগীকে না-ছোঁঁন। সোসাইটিতে যুক্ত এক বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক এ-ও বলছেন, “আইসিইউ-আইটিইউয়ে এক স্টেথোয় একাধিক রোগী দেখা যাবে না। ডাক্তারদের ফুলহাতা শার্ট পরাও উচিত নয়। শার্টের হাতা একাধিক রোগীর শরীর স্পর্শ করলে জীবাণু ছড়াতে পারে।” ক্রিটিক্যাল কেয়ার বিশেষজ্ঞ সুশ্রুত বন্দ্যোপাধ্যায় জানাচ্ছেন, “আপাত সুস্থ মানুষকে জীবাণু আক্রমণ করে না। অসুস্থ শরীরকে করে। তাই আইসিইউ-আইটিইউয়ে সংক্রমণের সম্ভাবনা বেশি, কারণ সেখানে গুরুতর অসুস্থদেরই ভিড়।”
অতএব সেখানে সতর্কতাও অনেক বেশি প্রয়োজন। তা কতটা মানা হচ্ছে এ শহরে, এ রাজ্যে?
উপরের তিনটে দৃশ্যেই তার একটা আন্দাজ মিলছে। যা ‘প্রতিষ্ঠিত’ হচ্ছে চিকিৎসক সুকুমার মুখোপাধ্যায়ের মন্তব্যে। “ইন্ডোর, আইসিইউয়ের গঠনটাই তো আলাদা হওয়া উচিত! কোথাও হয় না। আইসিইউ-আইটিইউয়ে দু’টো বেডের মাঝে অন্তত চার ফুট ফারাক থাকার কথা। কেউ রাখে না। চার-পাঁচ ঘণ্টা অন্তর ওয়ার্ড সাফ হওয়া দরকার। হয় না। ভর্তি হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে রোগীকে পরিচ্ছন্ন করার চল নেই। মেডিক্যাল বর্জ্য নিষ্কাশনের দিকেই বা ক’জন নজর দেয়?” আক্ষেপ সুকুমারবাবুর।
আরও অভিযোগ, রোগী ‘হাতছাড়া’ হওয়ার ভয়ে এবং বেশি রোগী দেখার তাগিদে বহু ক্ষেত্রে ডাক্তারেরা অস্ত্রোপচার-পূর্ববর্তী সতর্কতা অবলম্বন করেন না। যেমন হাঁটুবদলের আগে সোদপুরের অশোক মাইতির ইসিজি ও রুটিন কিছু রক্তপরীক্ষা হয়েছিল। অথচ দাঁতে যে একটা সংক্রমণ আছে, সংশ্লিষ্ট ডাক্তার তার খোঁজই রাখেননি! অপারেশনের পরে হাসপাতালে থাকাকালীন দাঁতের সংক্রমণ ও ‘হসপিটাল অ্যাকোয়ার্ড ইনফেকশন’-এর সাঁড়াশি আক্রমণে অশোকবাবুর প্রাণ যায়। বিশেষজ্ঞদের বক্তব্য, যে কোনও অসুস্থতায় দীর্ঘ হাসপাতালবাসের পরে বাড়ি ফিরে কী ভাবে থাকা উচিত কিংবা কোন কোন উপসর্গ দেখা দিলে অবিলম্বে ডাক্তারের সঙ্গে যোগাযোগ করতে হবে, তা রোগী ও বাড়ির লোককে বিশদে জানিয়ে রাখা হাসপাতালের কর্তব্য। কিন্তু বহু ক্ষেত্রে তা হয় না। ফলে সংক্রমণের উৎসটা বোঝা যায় না। সেপ্টিসেমিয়ার ঘটনায় হাসপাতাল সহজে দায় ঝেড়ে ফেলতে পারে।
হাসপাতালে সংক্রমণ বিশ্ব জুড়ে ঘটলেও এ দেশে হারটা বেশি কেন?
ব্যাখ্যা হিসেবে ‘সমস্ত স্তরে’ সচেতনতার অভাবের প্রসঙ্গ বার বার উঠে আসছে। আঙুল উঠছে হাসপাতালকর্মীদের ‘গয়ংগচ্ছ’ মনোভাবের দিকেও। এক বিশেষজ্ঞের কথায়, “নার্সদের যথাযথ ট্রেনিং নেই। অপারেশনের সরঞ্জাম ঠিকঠাক জীবাণুমুক্ত করা হয় না। মোটা টাকা নিলেও রোগীরা যথাযথ পরিষেবা পাচ্ছেন কি না, সে ব্যাপারে ন্যূনতম নজরদারি চালায় না বহু হাসপাতাল।”
কেন এত অনিয়ম?
বিভিন্ন হাসপাতালের কর্তাদের দাবি, দু’টো শয্যার মধ্যে চার ফুটের ব্যবধান কিংবা রোগীপিছু আলাদা সরঞ্জাম ইত্যাদির বন্দোবস্ত করতে গেলে খরচ এক ধাক্কায় বহু গুণ বেড়ে যাবে, যা অনেকেই বহন করতে পারবেন না। কিন্তু নিখরচায় চিকিৎসা হলেও কি চিকিৎসা-পরবর্তী সংক্রমণ নিয়ে রোগীর বাড়ি ফেরাকে বৈধতা দেওয়া যায়?
এ রাজ্যে রোগী-স্বার্থরক্ষায় নিয়োজিত সংগঠনগুলি জানিয়েছে, জ্বর ছাড়া কেউ হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার তিন দিনের মধ্যে জ্বর এলে ধরে নিতে হবে, ‘হসপিটাল অ্যাকোয়ার্ড ইনফেকশন’ দায়ী। ছাড়া পাওয়ার পরে জ্বর-সংক্রমণ হলেও একই সম্ভাবনা। অথচ অধিকাংশ মানুষ এ বিষয়ে সচেতন নন। ইদানীং ক্রেতা-সুরক্ষা আদালতে কিছু মামলা হচ্ছে। ব্যস, ওই পর্যন্ত।
সংগঠিত স্তরে প্রতিবাদ না-উঠলে হাসপাতালকে যে হুঁশিয়ার করা যাবে না, সকলেই তা মেনে নিচ্ছেন।
(শেষ)



First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.