পিঙ্কিকে দেখে দীর্ঘ অজ্ঞাতবাস ভাঙতে চান বন্দনা
পিঙ্কি প্রামাণিকের পাশে সাধারণ মানুষকে দেখে এগারো বছরের অজ্ঞাতবাস থেকে প্রকাশ্যে ফিরতে চান এক হতভাগ্য ভারতীয় ফুটবলার।
লিঙ্গ বদলের জেরে যাঁর পুরো জীবন আমূল পাল্টে গিয়েছে।
এক যুগ তিনি বাড়িছাড়া। সবাই ভুলে গিয়েছে তাঁকে। বাবা মারা গিয়েছেন, তাঁকে শেষ দেখা দেখতেও আসতে পারেননি ‘সমাজের’ ভয়ে। কৃষ্ণনগরের পুলিশ এক বার নারী পাচারকারী বলে তাঁকে জেলে রেখে দিয়েছিল বাহাত্তর ঘণ্টা। থার্ড ডিগ্রির দাগ এখনও তাঁর শরীরে।
কোনও ভোটার পরিচয়পত্র নেই। রেশন কার্ড নেই। ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট খোলার অধিকার নেই। থাকার একটা স্থায়ী জায়গা নেই। উত্তর চব্বিশ পরগনার বাড়ি থেকে পালিয়ে উত্তরবঙ্গের এক শহরে তিনি সংসার পেতেছেন কোনও মতে। সে শহরের নাম বলতে আপত্তি। সেখান থেকে ফোনে তাঁর আক্ষেপ, “আমার একটা মাটি চাই, পরিচয় চাই। এ ভাবে সমাজ আমাকে দূরে সরিয়ে রাখবে কেন?” সঙ্গে প্রশ্ন, “মানুষের জীবন কি সমাজের চেয়ে বড়? মানুষ সমাজ তৈরি করে, না সমাজ মানুষকে?”
ইনিই বন্দনা পাল। পনেরো বছর আগে তাঁর গোলেই বাংলার মেয়েরা ফুটবলে শেষ জাতীয় চ্যাম্পিয়ন হয় মণিপুরকে হারিয়ে। মেয়েদের নেহরু কাপে চারটি গোল করেন তিনি। হারিয়ে যাওয়া সেই মুখ এত বছর বাদে আবার প্রকাশ্যে!
এখন সেই বন্দনার পায়ে ফুটবল নেই। উত্তরবঙ্গের ওই শহরে তাঁর জীবন চলে দিনমজুরি করে। বাড়িতে রং করে, ভ্যান চালিয়ে। ঠিকাদারের অধীনে কাজ করে। আর পুজোর মরসুমটা ঠাকুর গড়েন। গ্যাব্রিয়েল বাতিস্তুতার ভক্ত বন্দনা খেলার সময়েও বাড়িতে ঠাকুর গড়তেন। গোবরডাঙার অদূরে ইছাপুর বাজারের বাড়িটা অনেক সাধ করে নিজের টাকায় বানিয়েছিলেন। “প্রত্যেকটা ইটে আমার রক্ত লেখা রয়েছে। কিন্তু আমার সেখানে ঢোকার অধিকার নেই। কোনও আত্মীয়ই যোগাযোগ রাখে না। এত বছরে এক বার এক খুড়তুতো ভাই এসেছিল।” কাঁপছিল বন্দনার গলা। বন্দনা নন, এখন তিনি বনি পাল। একার চেষ্টায়, বহু দৌড়োদৌড়ি করে মেয়ে থেকে পুরুষ। তিন বছর হল এক জুলাইতেই বিয়ে করেছেন কৃষ্ণনগরের তরুণী স্বাতীকে। তাঁর প্রেরণাতেই পাচ্ছেন বেঁচে থাকার রসদ। “ও-ই আমায় কৃষ্ণনগর থানায় গিয়ে বাঁচিয়েছে। বলেছে, স্বেচ্ছায় আমার সঙ্গে এসেছে। নইলে পুলিশ আমাকে মেরেই ফেলত। ওরা বলছিল, আমি মেয়ে পাচার করছি।”
পাঁচ বছর বাংলার হয়ে খেলেছেন বন্দনা। মেয়েদের লিগে তাঁর প্রচুর গোল ছিল। কী ভাবে বদলে গেল জীবন? কেনই বা তাঁকে এত বছর আড়ালে পড়ে থাকতে হয়? রবিবার বন্দনা ওরফে বনি ফোনে যা বললেন, তা একেবারে গল্প-উপন্যাসের মতো। “আমি একাই ছয়-সাত জনকে স্বচ্ছন্দে কাটিয়ে গোল করতাম দেখে মেয়ে ফুটবলাররা বলতে শুরু করল, আমি ‘ছেলে’। সাইয়ের ডাক্তাররাও পরীক্ষা করে রায় দিল, আমি মেয়ে নই। তাই ব্যাঙ্কক এশিয়ান গেমসে সুযোগ পেয়েও খেলতে যাওয়া হল না। ইনকাম ট্যাক্স টিমে খেলতাম। ওখানে চাকরি হওয়ার কথা ছিল। সেটাও হল না। সব বদলে গেল।”
ইছাপুরের বাড়ির লোকেরা কী বলছেন? তাঁর মা নিভাদেবী সন্তানের কথা উঠলে খুব ব্যথিত, “আমি কোনও অশান্তি চাই না। মন থেকে চাই, ও বাড়ি ফিরুক। কিন্তু এ ব্যাপারে যা বলার আমার ছেলে আর বড় মেয়ে বলবে।” বন্দনার দিদি, বেসরকারি সংস্থার এজেন্ট শঙ্করীর কথা, “আমরা চাই, ও বাড়ি ফিরুক। সম্প্রতি ওকে ফোনে সেটাই বলেছি।” এ সব শুনে বন্দনা এতটুকু বিশ্বাস করতে রাজি নন। সাফ কথা, “এত বছর যোগাযোগ নেই। ইদানীং ফোনে যেতে বলছে। কিন্তু আমাকে আগের মতো থাকতে হবে। আমার স্ত্রীকে ওরা মানবেন না। আমার পক্ষে যাওয়া সম্ভব নয়।” বন্দনার দিদি বলছেন, বোন বাড়ি ছাড়ে ২০০৬ সালে একটি দুর্গাপুজোর উদ্যোক্তারা তাঁর উপর হামলা করায়। বনির স্মৃতি কিন্তু বলছে, বাড়ি ছাড়া ২০০১ সালে।
এত বছর আড়ালে থাকার পরে পিঙ্কিকে দেখেই উৎসাহিত বন্দনা। পিঙ্কির পাশে যে সব মেয়ে ফুটবলার দাঁড়িয়েছিলেন, তাঁদের দ্বারস্থ হয়েছেন। ফোনে প্রাক্তন তারকা কুন্তলা ঘোষদস্তিদারকে অনুরোধ করেছেন, “আমার জন্য কিছু করো।” কুন্তলারা সব মেয়ে মিলে কলকাতায় বন্দনাকে আনার চেষ্টা করছেন। বন্দনা সম্প্রতি ফোন করেছিলেন সল্টলেকের বিশিষ্ট চিকিৎসক বৈদ্যনাথ চক্রবর্তীকে, যিনি তাঁর জীবন বদলাতে সাহায্য করেছেন। বৈদ্যনাথবাবু এ দিন বললেন, “ও এশিয়াডে বাদ পড়ার পরে খেলতে চেয়েছিল। ওর সমস্যা ছিল ক্রোমোজোমের। ডাক্তারি টার্মে বলা হয়, কেরিওটাইপ। এখন শুনলাম, বিয়ে করে খুব সুখী আছে।” বন্দনা প্রথমে বিভিন্ন ডাক্তারের কাছে ঘোরাঘুরি করেছেন। প্রথমে মেয়ে হওয়ার চেষ্টা চালান খেলার জন্য। ডাক্তাররা বলে দেন, সেটা সম্ভব নয়। সব শুনে তাঁর ছেলে হিসেবে বেঁচে থাকার সিদ্ধান্ত নেওয়া।
রবিবার বিকেলে কথা বলার সময়, বাড়ির কাছে ঠাকুর গড়ার কাজে ব্যস্ত ছিলেন বনি। এ বার শহরের একটা দুর্গাপুজোর থিম তৈরির দায়িত্ব পেয়েছেন বলে মন খুব ভাল। “আমাদের মতো যাদের সমাজ দূরে সরিয়ে রেখেছে, তাদের নিয়েই কাজটা করার ইচ্ছে। সাপুড়িয়াদের লোকসংস্কৃতি, আদিবাসীদের নিয়ে কাজ করব।” বললেন তিনি। ফুটবল কোচিংয়ের ইচ্ছে হয় না? “আমার ফুটবলার পরিচয় তো এখানে কেউ জানে না। কে আমায় মানবে?” একা এমন লড়াই করার সাহস পেলেন কোথা থেকে? বেশ গুছিয়ে কথা বলেন বনি। প্রশ্নটা শুনেই জবাব এল, “কাউকে পাশে পাইনি দেখে রবীন্দ্রনাথের গানের লাইনটা মাথায় রাখতাম। যদি তোর ডাক শুনে কেউ না আসে, তবে একলা চলো রে!”

(সহ প্রতিবেদন সীমান্ত মৈত্র)




First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.