আদিগন্ত ছড়ানো ইটভাটা আর ভুট্টাখেত। ফতিমা বা রুকসানা কি খোলা চোখে আর কখনও দেখবেন তাকিয়ে? সপ্তাহান্তে হাটে যাওয়ার
পথে অথবা দিনের শেষে মোবাইল ফোনে মিঠে খুনসুটি করতে পারবেন
বন্ধুদের সঙ্গে? বৈশাখের ঝড়ে ইচ্ছা হলে ছুটে গিয়ে আম কুড়োনোর অধিকার থাকবে তাঁদের?
আপাতত উত্তর, না। নইলে ‘সামাজিক অনুশাসন’ টলে যাবে যে!
দিল্লি থেকে প্রায় ৭০ কিলোমিটার দূরে বাগপত জেলার আসারা গ্রাম। সরু গলি। যত্রতত্র মোষ আর ট্র্যাক্টরের হোঁচট সামলে পৌঁছনো গিয়েছে মহম্মদ আসলামের পেল্লায় উঠোনে। আসারা খাপ পঞ্চায়েতের অন্যতম মাথা তিনি। খাপের ফতোয়া নিয়ে দেশ জুড়ে সংবাদমাধ্যমে যে হইচই শুরু হয়েছে, তা সামাল দিতে চেষ্টার ত্রুটি করছেন না আসলাম। গ্রামে পা রাখা ইস্তক মেঠাই-এর দোকান থেকে খেতমজুর যার কাছেই জানতে চাওয়া হচ্ছে (অবশ্যই পুরুষ) তড়িঘড়ি দেখিয়ে দিচ্ছেন ‘সমাজ কর্তা’র বাড়ি।
“বাচ্চারা অসংযমী হলে বড়রা কি তাঁদের শাসন করে না?” পরিচয় দিতেই পাল্টা আক্রমণ মহম্মদ আসলামের। “সপ্তাহে এক বার হাট বসে। ইদানীং সেখানে মেয়েদের বড় বেশি ফোনের ঘটা। ছেলেরাও মেয়েদের ছবি তুলতে ব্যস্ত। এ সব তো বন্ধ হওয়া দরকার!” |
খাপের নির্দেশ মেনে মুখ ঢেকে রাস্তায়। —নিজস্ব চিত্র |
গত কাল ফতোয়ার তদন্তে রামালা থানার পুলিশ গ্রামে এসে দু’জন খাপ সদস্যকে আটক করেছিল। পুলিশের উপর হামলা চালিয়ে তাদের কার্যত ছিনিয়ে নিয়েছে গ্রামের মানুষ। তা হলে বকলমে এমন ‘অনুশাসনই’ কি চাইছেন আসারা-র মানুষ? গলির এক প্রান্তে গোয়ালসর্বস্ব উঠোন পার হয়ে একটি আধ পাকা বাড়ি। তিন জন যুবতী এবং ঘরের ভিতরে কারওই মুখ ঢাকা নয়। প্রসঙ্গ তুলতে একটু লজ্জাই পেলেন জায়রা পারভিন। সদ্য সাগাই হয়েছে, সামনে নিকাহ্। জানালেন, “আমার কাছ থেকে ফোন নিয়ে নেওয়া হয়েছে। যদি ওর ফোন আসে, তা হলে বাবার কাছ থেকে নিয়ে কথা বলি।” জায়রার দুই বোন রুবি এবং সোবি জানালেন, হাটে গিয়ে নিজের পছন্দ মতো কিছু কেনার উপায় নেই। “যা লাগবে আব্বুকে বলে দিতে হয়। উনি নিয়ে আসেন।”
বছর চারেক আগে গ্রামের মেয়ে ফতিমা ভালবেসে বিয়ে করে জাবরুদ্দিন নামে এক যুবকের সঙ্গে চলে গিয়েছিলেন হায়দরাবাদ। পরে ফিরেও আসেন। সেই ঘটনাই এখন উদাহরণ হিসেবে ফিরছে গ্রামের ‘কর্তাদের’ মুখে মুখে। তিন সন্তান এবং স্বামীকে নিয়ে গ্রাম ছেড়ে চলে যাওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে ফতিমাকে। ভাঙা ইটের ঘরে উৎকণ্ঠায় দিন কাটাচ্ছেন তিনি। বলছেন, “এই গ্রামে বড় হয়েছি। ছেড়ে যেতে হবে কেন?”
ফতিমারা আইন মোতাবেক বিয়ে করেছেন হায়দরাবাদের আদালতে। আদালতের বিবাহকে স্বীকৃতি দিচ্ছে না খাপ। পঞ্চায়েতের প্রধান মাস্টার শাকিল (যিনি ‘মাস্টারজি’ হিসেবে পরিচিত লোকমুখে) জানাচ্ছেন, মোবাইল ফোনের ব্যবহারের সঙ্গে বাড়ি থেকে পালিয়ে যাওয়ার সম্পর্ক রয়েছে। তাঁর কথায়, “রাস্তায় দাঁড়িয়ে মোবাইল-এ গান বাজানো, অনেক রাত পর্যন্ত কথা বলা এলাকার শান্তি ব্যাহত হচ্ছে। টাকা চুরি করে ছেলে-মেয়েরা পালিয়ে যাচ্ছে।” এই সমস্ত বন্ধ করতেই ১৫ জন খাপ সদস্য ‘একমত’ হয়ে ফতোয়া জারি করেছেন।
গ্রামের জনসংখ্যা প্রায় ৩০ হাজার। মেয়েদের স্কুল আছে। ২০ কিলোমিটার দূরেই কলেজ। ফি-বছর কয়েক জন সেখানেও যায়। এই ‘বারণ-নামা’য় তাদের ভবিষ্যৎ কী হবে? সমাজকর্তাদের কথায়, ‘ভালই হবে’। ‘অন্য দিকে’ মন যাবে না। এ ব্যাপারে তাঁদের হাত শক্ত করছে খোদ মুখ্যমন্ত্রী অখিলেশ যাদব থেকে কেন্দ্রীয় মন্ত্রী অজিত সিংহের (যিনি এখানকার সাংসদ) পরোক্ষ সমর্থন। অখিলেশ নিজে ফতোয়ার বিরোধিতা এড়িয়ে বলেছেন, যে সিদ্ধান্তই নেওয়া হোক, ভালর জন্যই যেন হয়। অজিত-পুত্র জয়ন্ত বলছেন, “এটা তো ঠিক ফতোয়া নয়! গুরুজনদের পরামর্শ!” এ কি স্রেফ রাজনৈতিক বাধ্যবাধকতা? নাকি আরও অন্য কোনও কারণ?
আসারার গ্রামে কোনও বিতর্ক নেই। সবাই কার্যত মেনে নিয়েছেন, ‘কোনও প্রশ্ন নয়, কোনও প্রশ্ন নয়!’ |