আক্ষরিক অর্থেই রাস্তার কাজিয়া! এ বার সড়ক নিয়ে শরিকি-লড়াই নামতে চলেছে রাস্তায়!
উত্তরবঙ্গ সফরে গিয়ে ডুয়ার্সের পথে জাতীয় সড়কের (৩১ডি) বেহাল অবস্থা দেখে ক্ষুব্ধ মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় কেন্দ্রের নিয়ন্ত্রণাধীন জাতীয় সড়ক কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে লাগাতার আন্দোলনের নির্দেশ দিয়েছেন দলীয় কর্মীদের। ইতিমধ্যে শিলিগুড়িতে বিক্ষোভ দেখাতে রাস্তায় নেমেও পড়েছে তৃণমূল। এ বার পাল্টা ‘হুমকি’ দিয়েছে কংগ্রেস। প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি প্রদীপ ভট্টাচার্য থেকে শুরু করে বহরমপুরের কংগ্রেস সাংসদ অধীর চৌধুরী, মাটিগাড়া-নকশালবাড়ির বিধায়ক শঙ্কর মালাকার তৃণমূলকে ‘হুঁশিয়ারি’ দিয়ে বলছেন, “জাতীয় সড়ক নিয়ে কেন্দ্রের বিরুদ্ধে যে আন্দোলন হবে, তা-ই হবে রাজ্যের পূর্ত দফতরের সামনেও!” কংগ্রেস নেতৃত্বের পাল্টা ব্যাখ্যা, জাতীয় সড়কের ভাঙাচোরা দশার সঙ্গে রাজ্য সড়কের চেহারার কোনও তফাত নেই। তা হলে কেন্দ্রকে দোষারোপ করে আন্দোলন হলে, রাজ্য সড়কের হতশ্রী চেহারার হাল ফেরানোর দাবিতে আন্দোলন হবে না কেন? প্রশ্ন তুলছেন অধীর-শঙ্করেরা।
জোট শরিক কংগ্রেসের আন্দোলনের হুঁশিয়ারিকে আবার গুরুত্ব দিতে নারাজ রাজ্যের পূর্তমন্ত্রী তথা তৃণমূল বিধায়ক সুদর্শন ঘোষ দস্তিদার। তাঁর বক্তব্য, “কংগ্রেসের রাজনীতি আমি বুঝি না! তারা মন্ত্রিসভায় আছে। সকলেরই যৌথ চেষ্টা হওয়া উচিত উন্নয়ন। গত এক বছরে আমাদের সরকার তো উন্নয়নের কাজ করছে। কংগ্রেসের কথাকে গুরুত্ব দিচ্ছি না। কারণ, পূর্ত দফতরের রাস্তাগুলো যথেষ্টই ভাল।”
রাষ্ট্রপতি এবং উপরাষ্ট্রপতি নির্বাচন নিয়ে কংগ্রেস-তৃণমূলের সংঘাত তুঙ্গে। সড়ক নিয়ে টানাপোড়েন সেই বিবাদেই আরও ইন্ধন দিতে চলেছে। তৃণমূল নেত্রী অভিযোগ করেছেন, “জাতীয় সড়ক সারানো নিয়ে কেন্দ্র টালবাহানা করছে। রাজ্যের হাতে এ কাজ থাকলে আমরা পূর্ত দফতরকে দিয়ে কবেই করিয়ে নিতাম। এ বার কিন্তু ধৈর্যের বাঁধ ভেঙে যাচ্ছে!” মুখ্যমন্ত্রীর আগে জাতীয় সড়কের বেহাল অবস্থা নিয়ে জনস্বার্থে মামলা করেছেন কলকাতা হাইকোর্টের প্রধান বিচারপতি জে এন পটেল।
মুখ্যমন্ত্রীর উষ্মা প্রকাশের পরেই নড়েচড়ে বসেছেন প্রদেশ কংগ্রেস নেতারা। তাঁরা বুধবারই জাতীয় সড়ক কর্তৃপক্ষের (এনএইচএআই) উত্তরবঙ্গের দফতর থেকে রিপোর্ট আনিয়েছেন। সেই রিপোর্টে বলা হয়েছে, ফুলবাড়ি, জলপাইগুড়ি-ময়নাগুড়ি, ময়নাগুড়ি-ধূপগুড়ি, ফালাকাটা সংলগ্ন রাস্তার অংশে মেরামতের কাজ শুরু হয়ে গিয়েছে। রিপোর্ট অনুযায়ী, ফুলবাড়ি-বন্ধুনগর রাস্তার ১০ কিলোমিটারের মধ্যে ৪ কিলোমিটারের অবস্থা খুবই খারাপ। সেই খারাপ অংশ মেরামতের কাজ শুরু হয়েছে। বন্ধুনগর থেকে জলপাইগুড়ির অংশে ২২ কিলোমিটার রাস্তা মোটামুটি ভাল। তবে গত ১০ দিনে (বৃষ্টির কারণে) কিছু অংশে যে সমস্ত গর্ত হয়েছে, সেগুলি ভরাট করার কাজ শুরু হয়েছে। জলপাইগুড়ি-ময়নাগুড়ি অংশে প্রায় ১৯ কিলোমিটার রাস্তায় গত ১০ দিনে যে গর্ত হয়েছে, সেগুলিও মেরামতের কাজ শুরু হয়ে গিয়েছে। ধূপগুড়ি শহরের দিকে ৩.৬ কিলোমিটার রাস্তা মেরামতের কাজও চলছে। কোন ঠিকাদারি সংস্থাকে সেই কাজের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে রিপোর্টে তারও উল্লেখ করা হয়েছে। রাজ্যের মন্ত্রী এবং কংগ্রেস নেতা মানস ভুঁইয়ার কথায়, “কেন্দ্রীয় সড়ক পরিবহণ মন্ত্রী সি পি জোশীর সঙ্গে কথা হয়েছে। তিনি বিষয়টি সম্পর্কে অবহিত। প্রয়োজনীয় অংশে মেরামতির কাজ শুরু করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে বলে তিনি জানিয়েছেন।”
জাতীয় সড়ক কর্তৃপক্ষের ওই রিপোর্ট তাঁরা মানুষের সামনে প্রচারের জন্য তুলে ধরবেন প্রদীপবাবুরা। রিপোর্টের উল্লেখ করে কংগ্রেস নেতাদের বক্তব্য, জাতীয় সড়ক কর্তৃপক্ষ তো কাজ শুরু করে দিয়েছেন। কিন্তু রাজ্য সড়কের মেরামতের জন্য পূর্ত দফতর কী করেছে, তা তাঁরা রাজ্য সরকারের কাছে জানতে চাইবেন। শঙ্করবাবুর অভিযোগ, “মুখ্যমন্ত্রী আসার আগে বৃষ্টিতে জাতীয় সড়কের হাল খারাপ হয়েছে। কিন্তু দিদির নজর কাড়তে তৃণমূলের ১০-১৫ জন রাস্তায় নেমে বিক্ষোভ দেখিয়ে দিলেন! রাজ্য সড়ক ও লিঙ্ক রোডগুলির বেহাল অবস্থা নিয়ে আমরাও কিন্তু রাস্তায় নেমে বিক্ষোভ দেখাতে পারি!” অধীর অবশ্য বলেন, “আমরা তো আহম্মক বা অর্বাচীন নই যে, মানুষের অসুবিধা করে রাস্তা অবরোধ করে বিক্ষোভ দেখাব! তৃণমূলের লোকেরা নিজের সরকারের অপদার্থতা ঢাকার চেষ্টা করছে!” অধীরের যুক্তি, মমতা উত্তরবঙ্গে যাওয়ার আগেই রাস্তায় গর্ত ছিল। তাঁর সরকারের উচিত ছিল জাতীয় সড়ক কর্তৃপক্ষের নজরে এনে সারাইয়ের কাজ করিয়ে নেওয়া।
মমতা অবশ্য অভিযোগ করেছেন, জাতীয় সড়ক কর্তৃপক্ষকে বহু বার বলেও লাভ হয়নি। যার জন্য তিনি মুখ্যসচিব সমর ঘোষকে বিষয়টি নিয়ে সড়ক কর্তৃপক্ষের সঙ্গে কথা বলার নির্দেশ দিয়েছেন। পূর্তমন্ত্রী সুর্দশনবাবুর প্রশ্ন, মুখ্যমন্ত্রীর ক্ষোভপ্রকাশের পরে জাতীয় সড়ক কর্তৃপক্ষই যেখানে সমস্যার কথা স্বীকার করে নিয়েছেন, সেখানে কংগ্রেসের এমন হুঁশিয়ারির অর্থ কী? মহাকরণে শুক্রবারই পূর্তমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠকে বসেছিলেন কেন্দ্রীয় সড়ক ও পরিবহণ নিগমের ডিরেক্টর জেনারেল সি খাণ্ডস্বামী এবং ওই বিষয়ে সংসদীয় স্থায়ী কমিটির চেয়ারম্যান সুব্রত বক্সী। রাজ্য পূর্ত দফতর ও জাতীয় সড়ক কর্তৃপক্ষের প্রতিনিধিদের নিয়ে সমন্বয় কমিটি গড়ার প্রস্তাব উঠে এসেছে সেখানে, যাতে সময় বাঁচিয়ে রাস্তা মেরামতির কাজে দ্রুত কেন্দ্রের টাকা বরাদ্দ হয়। সুর্দশনবাবু বলছেন, “গত এক বছরে আমাদের সরকার উন্নয়নের কাজ করছে। এখন রাজ্য সড়কগুলির অবস্থা বেশ ভাল। তবে সবটাই ভাল, এমন দাবি করছি না। ৫-৬% হয়তো সারাই করতে হবে। আমরা সঙ্গে সঙ্গে তা করছিও। কিন্তু জাতীয় সড়কের ক্ষেত্রে দিল্লিতে সিদ্ধান্ত হচ্ছে, সময় লাগছে। রাস্তার হাল খারাপ হচ্ছে।”
যার পাল্টা অধীররা বলছেন, জাতীয় সড়কের কাজ তো শুরু হয়ে গিয়েছেই। এর পরেও তৃণমূল আন্দোলন করলে কংগ্রেসও পাল্টা আন্দোলনে নামতে তৈরি আছে!
নারদ নারদ! রাস্তা নিয়ে শাসক জোটের দুই শরিকের রাস্তার লড়াই দেখে বোধহয় এমনই বলছেন পথ-দুর্গতির ভুক্তভোগীরা! |