শীতকাল আসার সঙ্গে সঙ্গেই গাছের ডালে ডালে দেখা মিলবে অজানা রংবেরঙের নানা প্রজাতির পাখির। সেই সুদূর সাইবেরিয়া থেকে বংশবিস্তারের উদ্দেশ্যে ঠিক এই সময়ে তারা ভারত, পাকিস্তান, শ্রীলঙ্কার মতো নাতিশীতোষ্ণ অঞ্চলে হাজির হবেই। ঠিক যেমন মনার্ক প্রজাপতি শীতকালে সুদূর কানাডা থেকে মেক্সিকো উপকূলে হাজির হয় ডিম পাড়তে। আবার একই ভাবে বর্ষার প্রজননের সময় ইলিশ বা রেনবো ট্রাউট মাছ সমুদ্র থেকে হাজারমাইল পথ পাড়ি দিয়ে চলে আসে নদীতে। কিন্তু এই পরিযায়ী প্রাণীরা কী ভাবে এতটা পথ চিনে যাতায়াত করে? অনেক সময় তো প্রকৃতির নিয়মে ডিম পাড়ার পরেই মা মারা যায়। তা হলে সদ্যোজাত সন্তানরা কী করে পথ চিনে নেয়? বহু দিন ধরেই বিজ্ঞানীদের মনে এই প্রশ্ন পাক খাচ্ছে। এই নিয়ে অনেক গবেষণাও হয়েছে। আর সেই গবেষণা অনুযায়ী, বিজ্ঞানীদের অনুমান, এই পরিযায়ী প্রাণীরা পৃথিবীর চৌম্বক ক্ষেত্রকে কেন্দ্র করে দিক নির্ধারণ করে। কিন্তু কী ভাবে? |
সম্প্রতি ‘প্রসিডিং অফ দ্য ন্যাশনাল অ্যাকাডেমি অফ সায়েন্স’ জার্নালে প্রকাশিত একটি গবেষণাপত্রে এক দল বিজ্ঞানীর দাবি, রেনবো ট্রাউট মাছের দেহে তাঁরা খুঁজে পেয়েছেন বিশেষ ধরনের কোষ যার নিজস্ব চৌম্বক ক্ষমতা রয়েছে। বিজ্ঞানীদের মতে, এই কোষগুলোর বিশেষ ক্ষমতার সাহায্যেই হাজার হাজার মাইল দূরের পথ পাড়ি দিলেও পথ হারায় না ট্রাউট মাছেরা। গবেষক দলের অন্যতম ক্যালটেকের জৈব ভূবিজ্ঞানী জোসেফ কিরশ্চভিঙ্ক জানিয়েছেন, এই গবেষণার জন্য প্রথমে ট্রাউট মাছের ঘ্রাণেন্দ্রিয় থেকে কিছু কোষ আলাদা করা হয়েছিল। একটি কৃত্রিম চৌম্বক ক্ষেত্র সৃষ্টি করে তার মধ্যে ওই কোষগুলিকে রেখে দেওয়া হয়। জোসেফের দাবি, এর পর অনুবীক্ষণ যন্ত্রে ওই কোষগুলিকে পরীক্ষা করতে গিয়ে দেখা যায়, কিছু কোষ ওই চৌম্বক ক্ষেত্রের প্রভাবে বেঁকে গিয়েছে। জোসেফের মতে, কোনও কোষের যদি নিজস্ব চৌম্বক ধর্ম থাকে তা হলেই এক মাত্র তারা চৌম্বক ক্ষেত্রের প্রভাবে ঘুরে যেতে পারে। ভাল করে পরীক্ষা করতে গিয়ে দেখা যায়, রেনবো ট্রাউট মাছের ঘ্রাণেন্দ্রিয় থেকে নেওয়া কোষে অন্তত ১০০টি করে ‘চুম্বক ক্রিস্টাল’ রয়েছে।
গবেষক দলের অন্যতম বিজ্ঞানী মাইকেল উইনহফার জানিয়েছেন, পৃথিবী মাঝে মাঝে নিজের চৌম্বক ক্ষেত্রের পরিবর্তন করে। তা সত্ত্বেও পরিযায়ী প্রাণীরা কী করে দিক নির্ণয় করে, এই গবেষণার ফলে অবশেষে সেই রহস্যের সমাধান সম্ভব হল বলে মনে করছেন মাইকেল। তিনি জানান, এই চুম্বক ক্রিস্টালগুলি মাছের কোষপর্দায় থাকে। দীর্ঘ পথ পাড়ি দেওয়ার সময় পৃথিবীর চৌম্বক ক্ষেত্রের প্রভাবে ওই ক্রিস্টালগুলিতে আলোড়ন পড়ে যায়, যা ট্রাউটের মস্তিষ্কে বিশেষ বার্তা দেয়। পৃথিবীর চৌম্বক ক্ষেত্র পরিবর্তিত হওয়া মাত্র ট্রাউটির মস্তিষ্কে আগের থেকে কিছুটা অন্যরকম বার্তা পৌঁছয়। আর এই ভাবেই পরিবর্তিত পরিস্থিতির সঙ্গে খাপ খাইয়ে তারা যাত্রাপথের দিক নির্ণয় করে।
তবে, ট্রাউট মাছের মতো অন্য পরিযায়ী প্রাণীরাও একই রকম ভাবে চুম্বক ক্রিস্টালের সাহায্যে দিক নির্ণয় করতে পারে কি না সেটা অবশ্য জানা যায়নি। বিজ্ঞানীদের আশা, এই গবেষণার উপর নির্ভর করে পরিবহণ ক্ষেত্রে নতুন যুগের সূচনা হতে পারে। |