|
|
|
|
প্রবন্ধ... |
খেলার ছলে |
তাঁকে দেখেই, সেই প্রথম, মনে হল, হাতি-লোফাও সম্ভব!
মস্ত পালোয়ান, হাসিটি শিশুর মতো। ভীম থেকে হনুমান, তিনিই
আমাদের নিজস্ব ষষ্ঠীচরণ। দারা সিংহ। লিখছেন শোভন তরফদার
|
প্রথম যখন পড়েছিলাম, ছোটবেলায়, মনে হয়েছিল নিঘ্ঘাত আবোল তাবোল! দূর, এ রকম কখনও হয়? ‘একদিন এক গুণ্ডা তাকে বাঁশ বাগিয়ে মারল বেগে
ভাঙল সে বাঁশ শোলার মতন মট করে তার কনুই লেগে’!
কত বড় পালোয়ান হবে সে!
তাঁকে দেখে বুঝলাম, হয়। এমনও হয়।
তিনি কি মানুষ? ঠিক জানি না। আবছায়া ছোটবেলায় অ-মানুষিক অস্তিত্ব বলতে দুটো ছবি ভাসত। ভূত, যাকে ভয় পেতে হয়। ঠাকুর-দেবতা, যাকে নমো করতে হয়।
এই ভুতুম-ভগবান ছকের কোন দিকে তিনি পড়বেন?
তাঁকে দেখে একটু ভয় করে যদিও, কিন্তু ততটা নয় যে ভূত বলে ভাবব! বরং, ওই তো, মুখে অদ্ভুত একটা হাসি। ছেলেমানুষি হাসি। সেটা দেখেই আবার মনে হত, নাহ্হ্, এ ঠিক ঠাকুর-টাকুরও হবে বলে মনে হয় না। তা হলে?
সেই প্রথম তাঁর নাম শুনলাম। দারা সিংহ। তখন অবশ্য দারা সিং-ই বলতাম। ছোটরা তো কত কিছুই ভুল বলে।
দারা সিংহ মানে বিরাট একটা চেহারা। তাঁর কোনও অতীত নেই। ভবিষ্যৎ আমরা জানি না। থাকার মধ্যে দীর্ঘ, দশাসই আশ্চর্য একটা পেশিবহুল শরীর। সেই শরীর যা আমাদের নয়, কিন্তু তিনি তো আমাদেরই, ওদের টারজান থাকলে আমাদেরও দারা সিংহ আছে, তাই আমরাও যে যার মতো করে ওই শরীরের মধ্যে ঢুকে পড়তে পারি। পড়তেই পারি, কারণ ইচ্ছে হল এক ধরনের গঙ্গাফড়িং। ফলে, আমরাও ইচ্ছে হলে বলতেই পারি, এক দিন দারা সিংহের মতো ‘বডি’ বানাব।
হ্যাঁ, আমরা ‘বডি’ই বলতাম। কখনও খেলার মাঠে সুঠাম কাউকে দেখে, দেখেছিস কী বডি, যেন দারা সিং! কখনও টিংটিঙে বন্ধুকে টিটকিরি দিয়ে, ইস, কে আমার দারা সিং রে! পুজোর আগে অনেক বন্ধু যখন পাড়ার ক্লাব-টাবে গিয়ে ওজন তুলছে (হায়, তখনও অলিতে-গলিতে জিম-খানার কাল আসেনি!), আমরা ক্ষীণতনু কেউ কেউ জানলার শিকের ফাঁক দিয়ে সে দৃশ্য দেখতাম আর লুকিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলতাম। মনের মধ্যে একটা ছবি ভেসে উঠেই মিলিয়ে যেত।
দারা সিংহ।
|
|
ভুবনজয়ী। দারা সিংহ (ডান দিকে)। ছবি: দেবীপ্রসাদ সিংহ |
অর্থাৎ, তিনি ছিলেন। সে ভাবেই ছিলেন, যে ভাবে, আমাদের ঘরে চুনকাম করা নীলচে দেওয়ালে হলদেটে বালবের আলোয় ঝুলে থাকে বিদেশি নিসর্গ দৃশ্যের শস্তা ক্যালেন্ডার। আমরা জানি, কোনও দিনই হয়তো ওই সব জায়গায় যেতে পারব না। আসলে, ওই রকম কোনও জায়গা আদৌ হয় কি না, হতে পারে কি না, সে সবও ভাল জানি না। তবু ওই ছবিটা ঘরে রাখি। রাত্তিরবেলা, সমস্ত আলো নিভে যাওয়ার পরে নাইটল্যাম্পের আলতো আভায় ক্যালেন্ডারের চকচকে গা-টুকু শুধু দেখা যায়। মশারির ফাঁক দিয়ে আমরা তাকিয়ে থাকি। ঘুম আসে না।
সে রকমই দারা সিংহ।
জানি, কখনও ওই রকম হতে পারব না। ওই রকম সত্যি সত্যি হওয়া যায় কি না, তা-ও তো ভাল জানি না। হয়তো যায়, উনিই তো হয়েছেন, কিন্তু সে সব অবিশ্বাস্য ঠেকে। পঞ্চাশ ইঞ্চি বুকের ছাতি! একশো কিলো ছাড়িয়ে ওজন! পাঁচশোর বেশি লড়াই লড়েছেন, একটাও হারেননি!
সে সব কুস্তি, রক্ত জল-করা চিৎকার আর আছাড়, প্রতিদ্বন্দ্বীকে মাথার ওপর তুলে নিয়ে ছুড়ে ফেলে দেওয়া তর্ক ওঠে, সে সবই নাকি আসলে কুস্তি-কুস্তি খেলা! যতটা দেখানেপনা, ততটা প্রতিযোগিতা নাকি নয়! আসলে, সবটাই নেহাত বালখিল্যপনা! কিন্তু, সে তর্ক তো বড়দের, আমরা জানি, মহাভারত-এ একটা ভীমসেন থাকেন। তাঁর গায়ে বিরাট জোর, আর তিনি গায়ের জোরেই অদ্ভুত অদ্ভুত সব কাণ্ড করেন। সিনেমায়, সে সব হয়। আমরা বসে বসে দেখি। কে করবেন সেই কাণ্ড?
কে আবার, দারা সিংহ।
আমরা জানি, রামায়ণ-এ যতই রাম-লক্ষ্মণের কেরামতি থাক, রামানন্দ সাগর-এর ম্যাজিক-এ যতই একটা বাণ থেকে দশটা বাণ বেরোক, মহাবীর এক জন আছেন। হনুমান। কে হবেন সেই ‘মহাবীর’?
কে আবার, দারা সিংহ।
আগেও বলেছি, মুখে একটা ছেলেমানুষি হাসি। হনুমান-এর রূপকল্পে সেই হাসিটা আবার আমাদের সামনে ফিরে এল, আর দেখতে দেখতে এই গোটা দেশটা ছেয়ে ফেলল! যে কাজই বলা হোক তাঁকে, ‘জয় শ্রীরাম’ বলে ঝাঁপিয়ে পড়ছেন। ভয়ডর নেই। আশ্চর্য একটা বিশ্বাস আছে। বাচ্চারা যেমন বিশ্বাস করে, ‘মধুসূদন দাদা’ বলে ডাকলে কৃষ্ণঠাকুর দেখা দেবেনই, অনেকটা সে রকম! হনুমানের ওই সব দাস্যভাব-টাব ও সব তখন মাথাতেই আসেনি, অত কিছু জানতামও না, কিন্তু ওই বিশ্বাসটা জানতাম। প্রহ্লাদের গল্পে পড়েছি। ভক্ত ধ্রুব-র কথা পড়েছি। তাঁরা তো ছেলেমানুষই। আর এই মহাকপি, অত বড় চেহারা, রাক্ষসরাজ রাবণের সভায় বুক চিতিয়ে দাঁড়ান, লেজের আগুনে স্বর্ণলঙ্কা পুড়িয়ে ছারখার করে দেন, কী রকম একটা মনে হত, সে-ও আসলে বড় নয়, মানে শরীরে বিপুল হলেও মনে মনে ছোট।
কে সেই মানুষ, যে বড়, আবার ছোট-ও? দারা সিংহ।
পালোয়ান দারা সিংহ বিশুদ্ধ একটি ‘স্পেকট্যাকল’! আগেও নেই। পরেও নেই। শুধু যে মুহূর্তটা দেখছি, সেটা আছে। ওই তিনি হুঙ্কার দিচ্ছেন। ভিলেন-এর হাড় গুঁড়ো করছেন। ওই তিনি খালি গায়ে দাঁড়ালেন, শরীরময় ফুলে উঠল পেশি। সলমন খান-টানের ঢের আগে প্রথম যে ভারতীয় নায়ক খালি গায়ে এইট-প্যাক অ্যাবস নিয়ে পর্দায় এলেন, তিনি দারা সিংহ কি না, তা নিয়ে তর্ক চলতেই পারে।
গোবর গোহো-ও বিরাট পালোয়ান, যাকে বলে কিংবদন্তি, কিন্তু সিনেমা এবং টেলিভিশনের দৌলতে দারা যেমন প্রবাদ হয়ে উঠলেন, গণমাধ্যমের সেই প্রসাদ, নানা কারণে, গোবর পেলেন না, ফলে সেই জায়গাতেও যেতে পারলেন না। দারা সেটা পেলেন বটে, কিন্তু তাঁকে আবার ফর্মুলা নাচ-গানে একটু বেমানান লাগল!
দারা সিংহ, অতএব, একটি স্ব-মহিম জায়গা করে নিলেন। ‘স্ব-মহিম’, কারণ তিনি তাঁরই মতো। বড়, আবার ছোটও বটে। এই তো, মাত্র কয়েক দিন আগে আমাদের অনেকেরই ছোটবেলার একটা অংশ ছিঁড়ে নিয়ে তিনি চলে গেলেন। তিনি অত বড়, আবার ছোটও বটে।
আমরা জানি, আসলে কেউ বড় হয় না, বড়র মতো দেখায়... |
|
|
|
|
|