শিশুটি যত ক্ষণ পারে, তাহার মাকে ডাকিয়াছিল। ক্ষীণ কণ্ঠস্বর যত দূর সম্ভব, যত দূর তাহার সাধ্য, চড়ায় তুলিয়া সে প্রাণপণ জননীর শ্রুতি আকর্ষণ করিতে চাহিয়াছিল। জননী শোনে নাই। ক্রমে কণ্ঠ স্তিমিত হইয়া আসে। অবশেষে ক্ষুধার্ত শিশু স্তব্ধ হয়। এক সময় জননী তাহার খোঁজ লইতে আসে। তখন দেরি হইয়া গিয়াছে। গল্প নহে, সত্য ঘটনা। একটি ঘটনা নহে, এ রকম অনেক ঘটিয়াছে, ঘটিয়া চলিয়াছে। ইংল্যান্ডের শেফিল্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষকরা দীর্ঘ ও পরিশ্রমী পর্যবেক্ষণে জানিতে পারিয়াছেন যে, বড় শহরের শব্দবহুল এলাকায় চড়াই-শিশুদের মৃত্যুর হার শান্ত গ্রামাঞ্চলের তুলনায় বেশি, এবং এই তারতম্যের একটি প্রধান কারণ শব্দের প্রাবল্যে চড়াই-জননী তাহার ক্ষুধার্ত শাবকের ডাক শুনিতে পায় না, ফলে যথাসময়ে তাহার মুখে আহার পৌঁছাইয়া দিতে পারে না। কলিকাতার চড়াইরা অনেক দিন যাবৎ উধাও। তাহারা বোধ করি ইংল্যান্ডের চড়াই অপেক্ষা বুদ্ধিমান, সময় থাকিতে পাততাড়ি গুটাইয়াছে। পলাইয়া বাঁচিয়াছে, কারণ এই শহরে কখনও কোনও ক্ষুধার্ত চড়াই-শিশুর কান্নাও তাহার মায়ের কানে পৌঁছনো অসম্ভব।
ইংল্যান্ডের মতো দেশে বড় শহরে দিনের মধ্যে শব্দব্রহ্ম যে সর্বোচ্চ স্তরে উঠিয়া থাকেন, কলিকাতা শহরে যে কোনও সময়ে বোধ করি মধ্যরাত্রেও জীবনধ্বনি তাহা অপেক্ষা প্রবলতর। শুধুমাত্র নানাবিধ গাড়ির নিরবচ্ছিন্ন আর্তনাদই যে কোনও সভ্য শহরের নাগরিকদের কানের ভিতর দিয়া মরমে শক্তিশেল হানিত। কলিকাতার মানুষ নিশ্চয়ই ইতিমধ্যে বারো আনা বধির হইয়া গিয়াছেন, নচেৎ বাঁচিতেন না। আর, যে চার আনা অবশিষ্ট আছে, তাহাও প্রধানত কর্ণলগ্ন মুষ্টিফোনেই অহোরাত্র নিমগ্ন, ফলে অন্য ধ্বনি শুনিবার অবকাশও হয় না। চড়াইশিশু হইতে মানবশিশু ঈষৎ সৌভাগ্যবান, অন্তত মধ্যবিত্ত পরিবারে তাহাকে কাঁদিয়া কাঁদিয়া খাবার সংগ্রহ করিতে হয় না, বরং জননীরাই অহোরাত্র তাহাদের উদরপূর্তির সাধনায় নিরত থাকেন। তাই শব্দের অমিত তাণ্ডবেও তাহারা বাঁচিয়া গিয়াছে।
এহ বাহ্য। আক্ষরিক অর্থেই। বাহিরের আওয়াজ শেষ বিচারে নিতান্ত গৌণ সমস্যা। নানাবিধ বিধিনিষেধ দিয়া তাহাকে প্রশমন করা যায়, এমনকী কলিকাতাও সেই আশা করিতে পারে স্বপ্ন দেখিতে তো কোনও দোষ নাই। কিন্তু বাহিরের ধ্বনি থামিলেই কি বড়রা ছোটদের কথা শুনিতে পাইবেন? তাঁহাদের হৃদয় কি নিজস্ব বিপুল হইতে বিপুলতর শব্দভারে ভারাক্রান্ত নহে? অভিভাবকরা যদি তাঁহাদের সন্তানদের কথা শুনিতে পাইতেন, তাহাদের নিঃসঙ্গ, বিপন্ন, বিচ্ছিন্ন অস্তিত্বের আর্ত ধ্বনি যদি তাঁহাদের শ্রুতি এবং মনকে আকর্ষণ করিত, তাহা হইলে চতুর্দিকে বালকবালিকা এবং কিশোরকিশোরীরা সম্ভবত কিছুটা শান্তি এবং স্বস্তি অনুভব করিতে পারিত, জীবনযুদ্ধে প্রবেশ করিবার আগেই অগণিত ‘ভাবী নাগরিক’কে এমন বিধ্বস্ত, বিচূর্ণ হইয়া পড়িতে হইত না। তাহারা ডাকিতেছে, কিন্তু এই সময়ের শব্দতলায় তাহাদের কথা হারাইয়া যাইতেছে। জনকজননীরা যখন সেই ক্ষতির কথা জানিতে সমর্থ হইতেছেন, তখন অনেক দেরি হইয়া গিয়াছে। |