|
|
|
|
|
|
|
পুস্তক পরিচয় ২... |
|
থমকে দাঁড়াই থানের পুতুলের সামনে |
রবীন্দ্র-চিত্রকলার বিশেষজ্ঞ ও শান্তিনিকেতনের কলাভবনের কিউরেটর সুশোভন অধিকারীর রবীন্দ্রনাথকে ঘিরে বেশ কিছু রচনার সংকলন কেন্দ্রবিন্দুতে রবীন্দ্রনাথ (পত্রলেখা, ১৩০.০০)। গম্ভীর চালের বদলে ‘হাল্কা চালে বলা এই সব গল্পের মধ্যে যদি পাঠকের মনে কোনো ভাবনা উস্কে দেওয়া যায় তাহলেই যথেষ্ট হবে।’ —জানিয়েছেন লেখক। বহু বিচিত্র ঘটনার প্রেক্ষিতে কবিকে রেখে কখনও বিস্তৃত আলোচনায়, কখনও-বা বীজ ভাবনায় সত্যিই পাঠককে চিন্তার খোরাক জুগিয়েছেন সুশোভন। যেমন ‘রবি ঠাকুরের শ্বশুরবাড়ির দেশে’ রচনাটিতে: “গল্পগুচ্ছের ‘খাতা’ গল্পে উমার অসহায় বিদ্রূপের মধ্যে কি লুকিয়ে নেই লজ্জা আর অপমানে মৃণালিনীর মাটিতে মিশে যাওয়ার আখ্যান? অথবা ‘সমাপ্তি’র সেই ডানপিটে মৃন্ময়ী, ‘মেঘ ও রৌদ্র’ গল্পের গিরিবালা, ‘মাল্যদান’-এর কুড়ানির মধ্যে কি ফুটে ওঠেনি ফুলতলার সেই বালিকার ছবি? এমন কি ‘পোস্টমাষ্টার’ গল্পের রতনের অব্যক্ত জেদের মধ্যেও বুঝি চাপা আছে মৃণালিনীর আভা।” সনৎ করের প্রচ্ছদ।
দৃশী পাবলিশার্স থেকে বেরিয়েছে রানী চন্দের মানুষ নন্দলাল (৫০.০০) ও নানা লেখা (৬০.০০)। দু’টিতেই তাঁর অতুলনীয় স্মৃতিগদ্যে লেখিকা তুলে এনেছেন যেন এক শিল্পময় ভুবন ও ভ্রমণের জগৎ। কলাভবনের ছাত্রী ছিলেন রানী চন্দ, নন্দলাল বসু শিক্ষক। প্রথম বইটিতে রানী চন্দ লিখছেন ‘কলাভবনের চারি দিকের গাছগুলি বড়ো হয়ে উঠতে লেগেছে। ঝাউ ইউক্যালিপটাসের বাড় সকলের ঊর্ধ্বে। বকুল বড়ো ধীরে ধীরে নড়ে। প্রতিটি গাছের প্রতি নন্দদার অসীম মমতা, যেমন মমতা আমাদের প্রতি। একই ভাবে তিনি আমাদের লালন করে চলেছেন।’ আবার নন্দলালের শেখানো নিয়ে লিখছেন ‘নন্দদা দেশী রঙ তৈরী করতে লেগে গেলেন। আমাদের নিয়ে খোয়াইতে যান, বর্ষার জলে ধোয়া থিতিয়ে যাওয়া লাল পলিমাটি তুলে আনি। ধান ক্ষেতের সাদা মাটি আনি। নদীর ধার হতে এলামাটি আনি।... তখনকার দিনে অনেক ছবিই আঁকা হয়েছিল এই রকম দেশী রঙ দিয়ে।’
দ্বিতীয় বইটিতে লিখছেন তাঁর দ্বারকা-ভ্রমণ নিয়ে: ‘শ্রীকৃষ্ণের রাজধানী স্বর্ণদ্বারকা— নীল সমুদ্রের তীরে। ভাবলাম দেখে আসি এই ফাঁকে। নীল আকাশের তলে, নীল জলে ঘেরা সাদা বালির চড়ায় বিস্তীর্ণ নগরী; দূর দিগন্ত থেকে দেখা যায় মন্দিরের চূড়া,— অপূর্ব দৃশ্য। কৃষ্ণের রাজধানীর উপযুক্ত স্থানই বটে।’ ইউক্রেনের রাজধানী ‘কিভ’ বেড়াতে গিয়েছিলেন, তখন সোভিয়েত ইউনিয়ন ছিল। লিখছেন: নিপ্র নদীর তীরে ‘কিভ্’।... ‘কিভ্’ এর প্রান্তে এসে দাঁড়ালে দেখা যায় দিগন্তব্যাপী নিপ্র তার শাখা প্রশাখা ডাইনে বাঁয়ে বিস্তার করে চলে গেছে। দেখা যায় ওপারের উন্মুক্ত শ্যামলভূমি, বিস্তৃত নগরের বাসবসতি...। |
|
কৃষ্ণেন্দু চাকীর আঁকা প্রচ্ছদ সংবলিত লীনা চাকীর আরশিনগর-এ (পরম্পরা, ১৫০.০০) লোকশিল্পীরা যেন লেখিকার কথনে তাঁদের শিল্পের মায়াময় জগতে টেনে নিয়ে যান। আমাদেরই চেনা আরশিনগরের বাসিন্দা তাঁরা। লেখিকা এই শিল্পীদের ও তাঁদের শিল্প-উপকরণ সম্পর্কে শুরুতেই লিখছেন: ‘শিশির-সিক্ত এক ভোরে গ্রামের পথ দিয়ে হেঁটে যেতে যেতে দেখি কারা মরাই বাঁধছেন। ঢেঁকিঘরে বসে শিঙে বানানো দেখি। বনপথ দিয়ে হেঁটে যেতে যেতে থমকে দাঁড়াই থানের পুতুলের সামনে। কুলোর কারিগর নাম-মাহাত্ম্য শোনান।’ হোগলার পাটি, কাঁথাফোঁড়ের আচল, শোলার হীরামন পাখি, বাহারি শাঁখ, তালপাতার পাখা, ডোকরা, পট— এ রকম আরও কত কী যে রয়েছে তাঁর আলোচনার ঝুলিতে!
সাহিত্যিক লোকনাথ ভট্টাচার্য রবীন্দ্রনাথের ছবি আঁকা নিয়ে লিখেছেন— রীতিমতো প্রাপ্তি পাঠকের কাছে। এবং মুশায়েরা থেকে বেরিয়েছে তাঁর ইংরেজি বই পেন্টিংস অব রবীন্দ্রনাথ টেগোর (১৫০.০০)। ভূমিকায় হিরণ মিত্র জানিয়েছেন যে, রবীন্দ্রনাথ যখন ছবি আঁকা শুরু করেন, সে-সময়টাকে নাকি জ্যোতিষীরা তাঁর প্রয়াণকাল নির্ধারণ করেছিলেন, তাই সে-মৃত্যুচ্ছায়া ছাপিয়ে জেগে উঠেছে তাঁর রং-কম্পোজিশন, আর সে-সমস্ত নিয়েই লিখেছেন লোকনাথ ভট্টাচার্য। একেবারে শেষে লিখছেন ‘দ্য ইউনিভার্সালিটি অব টেগোরস ইন্ডিয়ান সেল্ফ ইজ নোহোয়্যার মোর এমফ্যাসাইজড দ্যান ইন হিজ পেন্টিংস।’ কবির একগুচ্ছ ছবিও ছাপা হয়েছে যত্ন নিয়ে।
ইংরেজ রাজত্বে মালদহ জেলার শিক্ষা, সার্ধশতবর্ষে ‘মেঘনাদবধ কাব্য’, এক মিশ্র সংস্কৃতি ‘কর্মা-ধর্মা’, রবীন্দ্রনৃত্যে লোকনৃত্যের উত্তরাধিকার, গম্ভীরার মুখোশ, কালীঘাটের পট, চিত্রশিল্পী চিত্তপ্রসাদ, ঐতিহাসিক গৌড়-পান্ডুয়ার জলরঙের ছবি ও ভারতীয় শিল্পী সীতারাম ইত্যাদি নানাবিধ বিষয় নিয়ে প্রদ্যোত ঘোষের শিক্ষা শিল্প সংস্কৃতি ও অন্যান্য প্রবন্ধ (অক্ষর, ১৩০.০০)। এই প্রবন্ধাদির রচনাকাল ১৯৬৫-২০১১। মালদহের ইতিহাস, লোকবৃত্ত নিয়ে লেখকের বহু দিনের চর্চা, সে চর্চার কিছু গুরুত্বপূর্ণ ফসল ধরা রইল দুই মলাটে। |
|
|
|
|
|