|
|
|
|
শনিবারের নিবন্ধ |
এক বাঙালি গৃহবধূ |
তিনিই হয়তো আর ক’দিন পর হবেন দেশের ‘ফার্স্ট লেডি’। কী ভাবছেন প্রণব মুখোপাধ্যায়ের স্ত্রী?
শুভ্রা মুখোপাধ্যায়-এর দিল্লির বাড়িতে তাঁর সঙ্গে সময় কাটিয়ে এলেন সঙ্গীতা ঘোষ |
ঘরে ঢুকলেই তাঁর আঁকা রবীন্দ্রনাথের ছবি দৃষ্টি আকর্ষণ করে। বুক শেল্ফে প্রচুর বই। এক পাশে হারমোনিয়াম, পিয়ানো, তবলা, তানপুরা। অন্য দিকে একটা ইজেল। গৃহকর্ত্রী শুভ্রা মুখোপাধ্যায়ের হাতে পেন্টিং ব্রাশ, তিনি ক্যানভাসে আঁকছেন। মাঝে মধ্যে বসে পড়ছেন হারমোনিয়ামে। ছবি আঁকা, গানের পাশাপাশিই জুতো সেলাই থেকে চণ্ডীপাঠ মাছের ঝোলের ফোঁড়ন থেকে বাজারের খুঁটিনাটি, সবই সামলাচ্ছেন তিনি।
১৩ নম্বর তালকাটোরা রোডের কর্তা প্রণব মুখোপাধ্যায় তো বরাবরই ব্যস্ত মানুষ, তাই গিন্নি শুভ্রাকেই অতিথি আপ্যায়ন+গোটা সংসার+সব কিছু ‘ম্যানেজ’ করতে হয়। রাইসিনা হিল হয়তো তাঁর ভবিষ্যৎ ঠিকানা। কিন্তু তা নিয়ে মোটেই ভাবতে রাজি নন গৃহকর্ত্রী।
উপস্থিত সারা দিন ধরে অতিথিদের আসা-যাওয়া সামলাতেই ব্যস্ত তিনি। রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের আগে তাঁরা আসছেন শুভেচ্ছা আর শুভকামনা জানাতে। কর্তা বাড়িতে প্রায় থাকছেনই না। শরীর খারাপ নিয়েও উষ্ণ আপ্যায়ন জানাচ্ছেন শুভ্রাই। কর্ত্রীর নিজের হাতে বানানো ভেজিটেবল স্যান্ডউইচ, আলু বড়া, চা,কফি-সহ।
আর এ সবের ফাঁকে ফাঁকে চলছে তাঁর রবীন্দ্রসঙ্গীত ট্রুপ ‘গীতাঞ্জলি’-র আগামী অনুষ্ঠানের মহড়া। প্রণবের পরেই শুভ্রার জীবনের দ্বিতীয় প্রেম রবীন্দ্রগান। যার প্রচারে জীবনভর তিনি ব্রতী। এসে পড়েছেন দীপা বন্দ্যোপাধ্যায়, ইলা বন্দ্যোপাধ্যায় আর মিতা মুখোপাধ্যায়। এঁরা ‘গীতাঞ্জলি’-র দীর্ঘদিনের সদস্য। ২৪ অগস্ট দিল্লির শ্রীরাম সেন্টারে ‘গীতাঞ্জলি’-র অনুষ্ঠান ‘ঋতুরঙ্গ’। শুরু হল গান, ‘মোর ভাবনারে কে হাওয়ায় মাতাল...’। গান থামিয়ে দীপা হঠাৎ বলে উঠলেন, “বৌদির (শুভ্রা) এই অনুষ্ঠানের জন্য ‘শীতের বনে কোন সে কঠিন আসবে বলে...’ গাওয়ার কথা। তিনি গাইবেন তো?”
কারণ: ১৯ তারিখের রাষ্ট্রপতি নির্বাচন।
প্রণব মুখোপাধ্যায় এবং পি এ সাংমা রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে পদপ্রার্থী। রাষ্ট্রপতির স্ত্রী মানে দেশের ‘ফার্স্ট লেডি’। দশ বছর পর এই দেশ পেতে চলেছে ‘ফার্স্ট লেডি’। বিদায়ী রাষ্ট্রপতি প্রতিভা পাটিলের পূর্বসূরি এ পি জে আব্দুল কালাম অকৃতদার। ঘটনাচক্রে এ বারের
‘ফার্স্ট লেডি’ হয়তো এক জন বাঙালি হতেও পারেন। ‘ফার্স্ট লেডি’-কে অবশ্যই কিছু ‘প্রোটোকল’ মেনে
চলতে হয়। তার মধ্যে অন্যতম— তিনি নাকি ‘এন্টারটেইন করতে পারেন না, এন্টারটেইন্ড হতে পারেন’। তেমনই শোনা গেল দিল্লির প্রগতিশীল মহিলাদের এক মজলিশে। তাই বোধহয় প্রশ্নটা এসে পড়ে, “বৌদি ২৪ অগস্ট গাইতে পারবেন তো?”
|
*** |
আর এক সন্ধ্যায় তালকাটোরা রোডে চলছিল নানা বিষয়ে আলোচনা। অতিথিরা মুখোপাধ্যায় দম্পতির পুরোন বন্ধু। তবে অবশ্যই কোনও রাজনৈতিক প্রসঙ্গ নয়। বা রাষ্ট্রপতি নির্বাচন সংক্রান্ত কোনও কথাও নয়। মুখোপাধ্যায় পরিবারে, বাড়ির অন্দরে, এ সব নিয়ে আলোচনায় কেউ-ই উৎসাহী নয়। এ ব্যাপারে শুভ্রা দারুণ বাস্তববাদী। তাঁর কাছে নস্টালজিয়া আছে, আজকের দিনটা দারুণ ভাবে উদ্যাপন করা আছে, কিন্তু আগামী দিন নিয়ে কোনও স্বপ্নের জালবোনা নেই। তাই ১৯ জুলাই বা তার পরের দিনগুলি নিয়ে কোনও আলোচনায় তিনি আগ্রহী নন, কাউকে প্রশ্রয়ও দেন না। তিনি অনেকটাই নিভৃতচারিণী। একা একাই রবীন্দ্রগান গেয়ে চলেন গুনগুনিয়ে।
রাষ্ট্রপতি পদপ্রার্থীর গৃহিণী নিরুত্তাপ হলে কী হবে, দিল্লি আর কলকাতার নানা মহলে (বিশেষ করে মহিলা মহলে) প্রবল উত্তেজনা। যদি রাষ্ট্রপতিভবনে বাঙালি রমণীর পদচিহ্ন পড়ে তাহলে কি মেনুতে পোস্ত ঢুকবে? ‘স্টেট ডিনার’-এ কি থাকবে চিতল মাছের মুইঠ্যা, এঁচোড়ের ডালনা বা পিঠেপুলি, পাটিসাপটা, নারকোলের নাড়ু? কালীঘাটের পট, বাঁকুড়ার পোড়ামাটির ঘোড়া, মেঝেতে খড়িমাটির আল্পনা... বাঙালির একান্ত নিজস্ব এই সব জিনিস কি স্থান পাবে রাইসিনা হিল-এ?
শুভ্রা কিন্তু অবিচল। সরোবরের মতো শান্ত। বাঙালি পদই তাঁর বাড়ির মেনুতে স্থান পেয়েছে বরাবর। প্রণববাবুর ‘ফেভারিট’ আলুপোস্ত আর কলাইয়ের ডাল তিনি রাঁধেন। আগামী দিনেও রাঁধবেন। “দেশে থাকলে ওঁর খাওয়াদাওয়া একেবারে বাঙালি মতে। তা তো আর রাতারাতি পালটে যেতে পারে না,” শুভ্রার উত্তর।
আর স্টেট ডিনারে চিতল মাছের মুইঠ্যা?
শুভ্রা নির্বিকার। ও সব বিষয়ের উত্তর একমাত্র ২২ জুলাইয়ের পরেই পাওয়া যাবে।
|
*** |
বন্ধুরা অবশ্য প্রণব-শুভ্রার বর্ণময় দাম্পত্যজীবন নিয়ে আলোচনায় অনেক বেশি আগ্রহী। আচ্ছা কোনও ‘রোম্যান্টিক’ ছবি নেই দু’জনের? “ধ্যাৎ,” হঠাৎ যেন লজ্জা পেলেন শুভ্রা। “আমাদের বাড়িতে ওসব আদিখ্যেতা নেই। শ্বশুরমশায়কেও দেখিনি। তোদের দাদাকেও না। প্রকৃত প্রেম মানে তো মঙ্গলকামনা। রোজ স্নান করে উনি আমার মাথায় ঠাকুরের নাম জপ করে দেন। সেটা কি ভালবাসা নয়?” পাল্টা প্রশ্ন করেন প্রয়াত কামদাকিঙ্কর মুখোপাধ্যায়ের পুত্রবধূ।
কিন্তু বন্ধুরা কি সহজে ছাড়েন? “বাংলাদেশি ঢাকাইটা কবে পরবে?” “সে পরলেই হবে, এই তো কী সুন্দর
তাঁত পরে আছি।” একান্ত আটপৌরে শাড়িটার দিকে
দৃষ্টি আকর্ষণ করলেন শুভ্রা। ঢাকাই শাড়িই, বিশেষ করে সাদা জমির উপর কালো, লাল বা সবুজ-নীল-হলুদের নক্শা ঠিক পাশের বাড়ির মা-মাসিমার যেমন পছন্দ, তেমনই পছন্দ শুভ্রার। কোনও বিশেষ অনুষ্ঠানের জন্য কোনও বিশেষ শাড়ি তিনি চিহ্নিত করে রাখেন না কখনওই, যা তখন মনে ধরে সেটাই পরে নেন। “কেন, দামি শাড়ি পরলে বুঝি আমি মানুষটার দাম বেড়ে যাবে?” হাসিমুখে প্রশ্ন করেন তিনি।
এর পরই এসে যায় সম্পূর্ণ অন্য প্রসঙ্গ।
“অমলতাস গাছ ইন্দিরা গাঁধী এনেছিলেন দিল্লিতে। কী সুন্দর হলদে রং... হলদে রং আমার ভীষণ প্রিয়।” জানালেন শুভ্রা। “তা তুমি বুঝি হলুদ ইন্টিরিয়র করবে?” প্রশ্ন করেন এক বান্ধবী। কোন ইন্টিরিয়রের প্রসঙ্গ উঠছে, তা না বললেও স্পষ্ট।
“হলদে রং দেওয়ালে খুব বিচ্ছিরি লাগবে। তবে অমলতাসের হলদে ফুলে সূর্যাস্তের রং... ইন্দিরাজিও ভালবাসতেন।” আবারও ইন্দিরার প্রসঙ্গ উঠতেই শুভ্রা মনে করিয়ে দিলেন তাঁর সাংস্কৃতিক সংগঠন ‘গীতাঞ্জলি’-র নাম ইন্দিরাই দিয়েছিলেন। শুভ্রার ডাক নাম গীতা, সেই গীতার অঞ্জলি, ‘গীতাঞ্জলি’।
‘গীতা’ থেকে ‘শুভ্রা’ হয়ে ওঠার মজাদার কাহিনিও শোনালেন তিনি। “আমাদের ছেলেবেলায় একটা স্নো পাওয়া যেত। বানানটা এস ইউ ভি আর এ। স্নো মাখলে মুখটা খুব চকচক করত, ঘাম হত। আমি তো কালো ছিলাম, স্নোর কৌটোটা আমার জাদুকাঠি মনে হত।” সেই ‘এস ইউ ভি আর এ’ থেকেই নাম হল ‘শুভ্রা’।” “আর বিয়েতে কী হয়েছিল জানো?” খোশমেজাজে বলে চলেন তিনি, “সম্প্রদানের সময় ওঁর ফর্সা-সুন্দর হাতের উপর আমার হাত। আমার বন্ধুরা এমন পাজি, শুনিয়ে শুনিয়ে বলে কি না, ‘দ্যাখ দ্যাখ, ঠিক যেন রজনীগন্ধার উপর ভ্রমর বসে আছে।’” বললেন শুভ্রা। অর্থমন্ত্রীর জন্য বিশেষ ভাবে বরাদ্দ বিশাল বাংলোতে কিন্তু থাকেন না মুখোপাধ্যায় দম্পতি। ১৩ নম্বর তালকাটোরা রোডের বাড়িটিতে বহুদিন ধরে বাস করছেন মুখুজ্জ্যে পরিবার। মধ্যবিত্ত সংসারের পরিবেশ-গন্ধ যে বাড়ির হাওয়ায় হাওয়ায়।
শুভ্রার পরনে তাঁতের শাড়ি, হাতে শাঁখা-পলা-নোয়া, সিঁথিতে-কপালে গাঢ় সিঁদুর। স্বামীর সঙ্গে বা নিজে অনুষ্ঠান করতে দেশবিদেশ কত না ঘুরেছেন, কত না রাষ্ট্রপ্রধানদের সঙ্গে দেখাসাক্ষাৎ করেছেন। সেই সময় শাড়িটা হয়তো একটু দামি পরেছেন, কিন্তু সাজসজ্জা কখনওই পাল্টাননি। “আমার মা বলতেন কটা মেয়ের ভাগ্য হয় চিরদিন শাঁখা- পলা পরে থাকার” বিনা দ্বিধায় বলে ফেলেন ‘ভি ভি আই পি’ গৃহবধূটি।
|
*** |
কথায় কথায় চলে আসে প্রয়াত দুই রাষ্ট্রপতি ফকরুদ্দিন আলি আহমেদের স্ত্রী বেগম আবিদা এবং কে আর নারায়ণনের স্ত্রী উষার প্রসঙ্গ। শোনা যায় রাষ্ট্রপতি ভবনে টিউলিপ চাষ শুরু করেন উষা। নেদারল্যান্ডসের রাষ্ট্রপ্রধান রাইসিনার বিশাল প্রান্তর দেখে নাকি টিউলিপ চাষের পরামর্শ দিয়েছিলেন। পায়রার উপদ্রব থেকে বাঁচতে নাকি ভবনের করিডর ‘চিকেন ওয়্যার’-এ ঘিরে দিয়েছিলেন আবিদা। আটপৌরে বাঙালি গৃহবধূ যদি রাষ্ট্রপতিভবনের বাসিন্দা হন, তিনি কী করবেন?
টিউলিপের প্রসঙ্গ উঠতেই শুভ্রা চলে গেলেন তাঁর ছেলেবেলায়। তাঁদের বাড়ির পুকুর পাড়ে তিনটে হিজল গাছ ছিল। এক দিন খেলতে খেলতে তিনি গাছের তলায় ঘুমিয়ে পড়েছিলেন। হিজলের লাল ফুলে সম্পূর্ণ ঢেকে গিয়েছিল শিশুকন্যাটি। তাঁর মা ‘গীতা, গীতা’ বলে অনেকক্ষণ ধরে খুঁজেছিলেন তাঁকে। তারপর মেয়েকে খুঁজে পেলেন মা। মা, মেয়েকে জড়িয়ে ধরে সেদিন নাকি খুব কেঁদেছিলেন!
মায়ের কথা বড্ড মনে হয় তাঁর আজকাল। কিন্তু সে তো অতীতের স্মৃতিচারণ। আর ভবিষ্যৎটা?
টিউলিপের মতো রাইসিনার প্রান্তরে কি সেই লাল ফুলের গাছ আছে? তার তলায় যদি কখনও
বসেন শুভ্রা, মনে পড়বে নিশ্চয়ই মায়ের কথা।
না, শুভ্রা তারও উত্তর দেবেন না। ওই যে বললাম না, শুভ্রা নস্টালজিয়া ভালবাসেন, কিন্তু ভবিষ্যৎ নিয়ে তাঁর কোনও মাথাব্যথা নেই। “আমার শাশুড়ি রাজলক্ষ্নীদেবী বলতেন, ‘যখন যেমন, তখন তেমন’। শাশুড়ি মার কথাই মেনে চলেছি সারা জীবন ধরে।”
আর ভবিষ্যতের কথা কেই বা বলতে পারে!
|
শুভ্রা মুখোপাধ্যায়ের ছবি পারিবারিক অ্যালবাম থেকে |
|
|
|
|
|