পথ-যন্ত্রণায় ক্ষুব্ধ, মামলা করলেন প্রধান বিচারপতিই |
এত দিনে বোধহয় পাথর নড়ল।
পিচের চাদর নেই। পাথর মাটি উঠে ছোটখাটো জলাশয়ের চেহারা নিয়েছে মাঝ রাস্তা। জলদাপাড়া সংলগ্ন মাদারিহাট থেকে হাসিমারা পর্যন্ত ৩১ নম্বর জাতীয় সড়ক দেখে চাষের মাঠ বলে ভুল হতে পারে। পর্যটকদের যাতায়াতের ওই গুরুত্বপূর্ণ রাস্তা বেহাল হয়ে আছে প্রায় এক বছর ধরে। পর্যটকদের পাশাপাশি এলাকার বাসিন্দারাও বিপাকে। মেরামতের উদ্যোগ নেই কর্তৃপক্ষের। হেলদোলও নেই কারও। অবশেষে কলকাতা হাইকোর্টের হস্তক্ষেপে ওই রাস্তার ভাগ্য বোধহয় খুলতে চলেছে।
কোনও আবেদনকারীর দায়ের করা জনস্বার্থের মামলার জেরে নয়। খোদ প্রধান বিচারপতি জে এন পটেল নিজে এই জনস্বার্থের মামলাটি দায়ের করেছেন। সম্প্রতি উত্তরবঙ্গে গিয়েছিলেন তিনি। হাসিমারা থেকে মাদারিহাট, ৩১ নম্বর জাতীয় সড়কের হাল দেখে তিনি এত ক্ষুব্ধ হন যে কলকাতায় ফিরে নিজেই একটি স্বতঃপ্রণোদিত জনস্বার্থের মামলা করেন। এ ব্যাপারে জলপাইগুড়ির জেলাশাসকের কাছ থেকে রিপোর্টও তলব করেন তিনি। জেলাশাসক তাঁর রিপোর্টে জানিয়েছেন, বর্ষার পরে ওই রাস্তা আর যানবাহন চলাচলের যোগ্য থাকে না। বিষয়টি তিনি জাতীয় সড়ক কর্তৃপক্ষ ও রাজ্যের পূর্ত দফতরকে জানিয়েছেন। শুক্রবার এই রিপোর্ট পড়ে আদৌ সন্তুষ্ট হতে পারেননি প্রধান বিচারপতি। বরং রাস্তার অবস্থা এখন আরও খারাপ হয়েছে জেনে তিনি চিন্তিত। |
বেহাল মাদারিহাট-হাসিমারা রোড। রাজকুমার মোদকের তোলা ছবি। |
রাজ্য সরকারের পক্ষে আইনজীবী সুমন গুপ্তের বক্তব্য, জাতীয় সড়কের রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব কেন্দ্রের। তারা টাকা দেয়, রাজ্য রূপায়ণ করে। কেন্দ্র টাকা না দিলে রাজ্য কাজ করতে পারে না। রাজ্য সরকারের এই বক্তব্য শুনে ক্ষোভ প্রকাশ করে প্রধান বিচারপতি বলেন, কে টাকা দেবে, কে কাজ করবে এ সব কথা শোনা আদালতের বিষয় নয়। তাঁর প্রশ্ন, কেন্দ্র ও রাজ্যের মধ্যে টাকা নিয়ে সমস্যা রয়েছে বলে একটি গুরুত্বপূর্ণ জাতীয় সড়ক এই ভাবে থাকবে? তাঁর মন্তব্য, কেন্দ্র টাকা দিচ্ছে না, টাকা ঠিক মতো না পাওয়ার জন্যই কাজ হেচ্ছে না এমন যুক্তি শুনতে রাজি নন তিনি। প্রধান বিচারপতির মতে, দুই সরকারের বোঝাপড়ায় আসা উচিত। এখনই ওই রাস্তা মেরামত দরকার। আগামী শুক্রবার ফের শুনানি হবে মামলাটির। দুই সরকারকেই সে দিন লিখিত ভাবে জানাতে হবে ৩১ নম্বর জাতীয় সড়ক নিয়ে তারা কী ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে।
মাদারিহাট থেকে হাসিমারা পর্যন্ত প্রায় ১৪ কিলোমিটার পথে পিচের চাদর উঠেছে অনেক দিন আগে। জায়গায় জায়গায় বিপজ্জনক গর্ত। এই সব খানাখন্দ আর ‘জলাশয়ে’ পেরিয়ে পর্যটকদের পৌছতে হচ্ছে জলদাপাড়া, বক্সা ব্যাঘ্র প্রকল্পের জঙ্গল ও ভুটানে। জলদাপাড়ার মতো গুরুত্বপূর্ণ পর্যটন কেন্দ্রের লাগোয়া রাস্তা এ ভাবে বেহাল পড়ে থাকায় ক্ষুব্ধ আলিপুরদুয়ারের কংগ্রেস বিধায়ক দেবপ্রসাদ রায় বলেন, “কোন রহস্যজনক কারণে ওই রাস্তা মেরামত করা হচ্ছে না সেটা বুঝতে পারছি না।” পুজোর মধ্যে রাস্তা সংস্কার করা না হলে জলদাপাড়া, বক্সাকে ঘিরে গড়ে ওঠা পর্যটন শিল্প মুখ থুবড়ে পড়বে বলে স্থানীয় বাসিন্দাদের আশঙ্কা। জলদাপাড়া টুরিস্ট লজের ম্যানেজার নিরঞ্জন সাহা বলেন, “পর্যটকরা এখানে পৌছে রাস্তার দশা দেখে বাইরে যেতে চান না।”
শুধু কি পর্যটন শিল্প মার খাচ্ছে? নিত্যযাত্রীরা প্রাণ হাতে নিয়ে যাতায়াত করছেন আলিপুরদুয়ার ও বীরপাড়ায়। রোগীকে হাসপাতালে নিয়ে যেতেই প্রাণান্ত বাড়ির লোকজন। চা বাগান কর্তৃপক্ষ দ্রুত নিলাম কেন্দ্রে চা পৌঁছে দিতে পারছেন না। হাসিমারার সুভাষিণী চা বাগানের ম্যানেজার অনিন্দ্য রায় বলেন, “প্রায় ৩০ কিলোমিটার ঘুরপথে চা পৌছে দিতে হচ্ছে। বাগানের রোগীকে হাসপাতালে নিয়ে যেতে বিপাকে পড়তে হচ্ছে। কর্তৃপক্ষ কেন ব্যবস্থা নিচ্ছে না বুঝতে পারছি না।”
ক্ষুব্ধ বাসিন্দারা জানান, এক বছর ধরে রাস্তাটি বেহাল। প্রতিদিন দুর্ঘটনা ঘটছে। মাধ্যমিক পরীক্ষা দিয়ে বাড়ি ফেরার পথে গাড়ি উল্টে কয়েক জন পরীক্ষার্থী জখম হয়েছে। বর্ষায় গর্তগুলি ছোটখাটো ডোবার আকার নেওয়ায় বাস-ট্রাক উল্টে পড়ছে। যন্ত্রাংশ ভেঙে গিয়ে প্রায়ই বাস বিকল
হয়ে যাচ্ছে।
বীরাপাড়া-মাদারিহাট পঞ্চায়েত সমিতির সভাপতি বিকাশ দাস বলেন, “নতুন কেউ বেড়াতে এলে বুঝতে পারবেন না এটা পথ, নাকি চাষের মাঠ। খয়েরবাড়ি থেকে হাসিমারা পর্যন্ত বেহাল রাস্তায় বাস চলাচলও বন্ধ হতে চলেছে। কর্মীরা সময় মতো অফিসে উপস্থিত হতে পারছেন না।”
ভরসা এখন হাইকোর্টের ওই মামলা। |