জেলবন্দি পিঙ্কি প্রামাণিকের ‘মানবাধিকার লঙ্ঘন’ ঘিরে অভিযোগের জল গড়াল আদালত থেকে ময়দানে।
এক জনস্বার্থ-মামলার প্রেক্ষিতে শুক্রবার কলকাতা হাইকোর্ট পুলিশকে বলেছে পিঙ্কির বিরুদ্ধে ওঠা ধর্ষণের অভিযোগের কেস ডায়েরি জমা দিতে। এবং সোনাজয়ী ওই প্রাক্তন অ্যাথলিটের সঙ্গে পুলিশ ও জেল হেফাজতে কোনও ‘গর্হিত’ আচরণ করা হচ্ছে কি না, তা জানতে রাজ্য সরকারের বক্তব্যও চেয়েছে কোর্ট। পাশাপাশি ভারতীয় ক্রীড়া-ইতিহাসে প্রায় নজির স্থাপন করে রাজ্যের মহিলা ক্রীড়াবিদদের একটি বিরাট অংশ এ দিন একজোট হয়ে পিঙ্কির ‘মানবাধিকার লঙ্ঘনের’ প্রতিবাদ জানিয়েছেন। এঁদের অনেকে অর্জুন ও পদ্মশ্রী খেতাবধারী। তাঁদের এ-ও প্রশ্ন, রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী এক জন মহিলা হওয়া সত্ত্বেও পিঙ্কিকে কেন এ ভাবে হেনস্থা হতে হচ্ছে? পিঙ্কিকে ‘হেনস্থা’র প্রতিবাদে এ দিন রাতে এক স্কুল-শিক্ষিকা দমদম সেন্ট্রাল জেলের সামনে অনশন শুরু করেছেন। আজ, শনিবার তাঁকেও সমর্থন জানাতে যাচ্ছেন মহিলা ক্রীড়াবিদেরা। |
এ দিকে পিঙ্কি প্রামাণিকের সঙ্গে পুলিশ-প্রশাসনের আচরণ সংক্রান্ত জনস্বার্থ-মামলাটির শুনানির পরে এ দিন আবেদনকারী ও সরকারপক্ষের বক্তব্য শোনে হাইকোর্ট। তার পরে প্রধান বিচারপতি জেএন পটেল ও বিচারপতি সম্বুদ্ধ চক্রবর্তীর ডিভিশন বেঞ্চ রাজ্যকে নির্দেশ দেয়, ওই অভিযোগ সম্পর্কে সরকারের বক্তব্য দু’সপ্তাহের মধ্যে হলফনামা দিয়ে আদালতকে জানাতে হবে। পুলিশকে দু’টি কেস ডায়েরিও জমা দিতে বলা হয়েছে। ধর্ষণের অভিযোগের কেস ডায়েরি, অন্যটি পিঙ্কির লিঙ্গ শনাক্তকরণ-সংক্রান্ত।
জনস্বার্থ-আবেদনকারীর আইনজীবী ভারতী মুৎসুদ্দি এ দিন সওয়ালে বলেন, “পিঙ্কি যে মহিলা নন, তা এখনও প্রমাণ হয়নি। তবু পুরুষ পুলিশকর্মীরা তাঁর দেহ পরীক্ষা করছেন, ওঁকে পুরুষদের সেলে রাখা হচ্ছে। এই ব্যবহার অভাবনীয় ও অমানবিক।” অন্য দিকে রাজ্য সরকারের তরফে জিপি অশোক বন্দ্যোপাধ্যায়ের দাবি, পুরনো একটা ছবি দেখিয়ে কিছু কথা বলা হচ্ছে। “পুরুষ পুলিশকর্মীরা নিজেদের কাজ করছেন, মহিলা কর্মীরাও নিজেদের কাজ করছেন। কোনও বেনিয়ম হচ্ছে না।” অশোকবাবুর বক্তব্য, কোথাও কোনও অভিযোগ থাকলে তা প্রথমে নিম্ন আদালতেই জানাতে হবে। হাইকোর্ট এ দিন বলেছে, পিঙ্কির লিঙ্গ নির্ধারণ পরীক্ষার ছবি ই-মাধ্যমে ছড়ানোর বিষয়ে যদি লালবাজারের সাইবার ক্রাইমে কোনও অভিযোগ দায়ের হয়, তা হলে পুলিশকে জানাতে হবে, তদন্ত করে তারা কী ব্যবস্থা নিল।
তবে চমকপ্রদ ঘটনাটি ঘটে আদালতের শুনানির ক’ঘণ্টা পরে, কলকাতা ক্রীড়া সাংবাদিক ক্লাবে। প্রাক্তন অ্যাথলিট জ্যেতির্ময়ী শিকদার, ফুটবলার শান্তি মল্লিক, সাঁতারু বুলা চৌধুরী, কবাডির রমা সরকার, ফুটবলার কুন্তলা ঘোষ দস্তিদার-সহ রাজ্যের খ্যাতনামা বহু মহিলা ক্রীড়াবিদ সেখানে হাজির হন, পিঙ্কির প্রতি আচরণের প্রতিবাদে আলতা-নীল কালিতে লেখা পোস্টার নিয়ে। এমনকী, সাতের দশকের নামী অ্যাথলিট রীতা সেনও ওই প্রতিবাদসভায় বক্তৃতা করেন। ছিলেন প্রাক্তন ফুটবলার সুব্রত ভট্টাচার্য, প্রাক্তন ক্রীড়ামন্ত্রী প্রয়াত সুভাষ চক্রবর্তীর স্ত্রী রমলা চক্রবর্তী এবং নারী নির্যাতন প্রতিরোধমঞ্চের শাশ্বতী ঘোষ। প্রত্যেকেই সরব হন পিঙ্কির ‘মানবাধিকার’ নিয়ে।
এ ব্যাপারে রাজ্য সরকার ও ক্রীড়ামন্ত্রী কেন নীরব, তা নিয়েও প্রশ্ন ওঠে ওই প্রতিবাদ সমাবেশে। হাইকোর্ট অবশ্য জানিয়েছে, পিঙ্কির জামিন তাদের বিবেচনাধীন জনস্বার্থ-মামলটির বিষয় নয়। নিম্ন আদালতের রায়ে অসন্তুষ্ট হলে পিঙ্কি হাইকোর্টে জামিনের আবেদন করতেই পারেন। যদিও এখনও তা জানানো হয়নি। পিঙ্কি-কাণ্ডে এ দিন সরকারের সমালোচনা করেছেন বিরোধী দলনেতা সূর্যকান্ত মিশ্রও। তিনি বলেন, “গ্রেফতারের পর থেকে পিঙ্কির প্রতি যে ব্যবহার করা হচ্ছে, তাতে মানবাধিকার লঙ্ঘিত হচ্ছে।” পশ্চিমবঙ্গে মহিলাদের প্রতি রাজ্য সরকার তথা মুখ্যমন্ত্রীর ‘দৃষ্টিভঙ্গির’ও সমালোচনা করেছেন সূর্যবাবু। পিঙ্কিকে হেনস্থার অভিযোগে তাঁর নিজের জেলা পুরুলিয়ায় ডিএম অফিসের সামনে এ দিন বিক্ষোভ দেখিয়েছে গণতান্ত্রিক মহিলা সমিতি। |