তাঁদের জন্যই মিছিল, গরহাজির ‘ইচ্ছুক-অনিচ্ছুকরা’
যাঁদের ‘পাশে থাকার বার্তা’ দিয়ে সিপিআই (এমএল) লিবারেশন মঙ্গলবার সিঙ্গুরের পথে নামল, সেই ‘ইচ্ছুক’ বা ‘অনিচ্ছুক’কোনও তরফের চাষিই পা মেলালেন না সেই মিছিলে। অন্তর্নিহিত বার্তাটা স্পষ্ট, সিঙ্গুর নতুন করে অশান্তি চায় না। চায় না ফিরে আসুক ২০০৬- এর পর সেই আগুনঝরা দিনগুলো।
গোপালনগরের মীরা মালিকের কথায় তারই স্পষ্ট ইঙ্গিত। পারিবারিক জমির পুরোটাই টাটাদের প্রকল্প এলাকায় অধিগৃহীত হয়েছে। ‘অনিচ্ছুক’ চাষি পরিবারের এই বধূর কথায়, “সংসারে ১০টা পেট। কী ভাবে যে এত দিন চালিয়েছি, তা আমরাই জানি। এখন সরকার যতটুকু সাহায্য দিচ্ছে, তা-ই বা কম কী? সমস্যার কিছুটা তো সুরাহা হচ্ছে। এখন নতুন করে কোনও আন্দোলন করে কী হবে!” এ প্রশ্ন তুলেছেন ‘অনিচ্ছুক’ জমিহারাদের অনেকেই। গোপালনগরেরই ভজহরি মালিকের বক্তব্য, “আমাদের যা হাল, তাতে সরকার যা দেবে, তা-ই হাত পেতে নিতে হবে। আন্দোলন-অশান্তি আর আমরা চাই না।”
লিবারেশনের নেতৃত্বে ‘সারা ভারত বাম সমন্বয়’-এর ডাকে এ দিন হাজার ছ’য়েক মানুষ মিছিলে সামিল হয়েছিলেন। বর্ধমান, হাওড়া, কলকাতা, নদিয়া এমনকী হুগলির অন্য প্রান্তের বহু মানুষ হাঁটলেও সিঙ্গুরের ‘ভূমিপুত্র’দের উপস্থিতি ছিল একেবারে হাতেগোনা।
সিঙ্গুরে সিপিআই (এমএল) লিবারেশনের নেতৃত্বে মিছিল। মঙ্গলবার প্রকাশ পালের তোলা ছবি।
লিবারেশন ‘ডাক’ দিয়েছিল, অধিগৃহীত জমি ‘পুনর্দখল’ করুন চাষিরা। ‘পুনর্দখল’ দূর অস্ত, মিছিলেই দেখা যায়নি ‘ইচ্ছুক’ বা ‘অনিচ্ছুক’ চাষিদের। কেন? দলের রাজ্য নেতা সজল অধিকারীর ব্যাখ্যা, “দীর্ঘ আন্দোলনের পরেও জমি-জট না কাটায় এখানকার মানুষ সব রাজনৈতিক দলের উপরেই হতাশ।” তবু আন্দোলন কেন?
সিঙ্গুরবাসীর মন বুঝেই বোধহয় লিবারেশনের পলিটব্যুরো সদস্য কার্তিক পাল বলেন, “সিঙ্গুরের চাষি-খেতমজুরদের পাশে আছি, এটা বোঝাতেই এখানে এসেছি। চাষিরা যে ভাবে আন্দোলন করবেন, আমরা তা-ই সমর্থন করব।”
লিবারেশনের কর্মসূচি ঘিরে কৌতূহল তৈরি হয়েছিল বিভিন্ন মহলে। বিকেল ৩টে নাগাদ কামারকুণ্ডু স্টেশনের সামনে থেকে মিছিল শুরু হয়। প্রকল্প এলাকার পাঁচিল ভেঙে ঢোকার চেষ্টা হবে কি না, তা নিয়ে সংশয়ে ছিল পুলিশ-প্রশাসনও। কিন্তু লিবারেশনের নেতাদের ‘সুর’ এ দিন তুলনায় ছিল অনেক ‘নরম।’ অশান্তির আশঙ্কায় প্রচুর পুলিশ মোতায়েন ছিল সিঙ্গুরে। প্রকল্প এলাকার যে সব জায়গায় পাঁচিল আগেই ভেঙে পড়েছিল, সেখানে ব্যারিকেড ছিল। শেষমেশ ‘অপ্রীতিকর’ কিছুই ঘটেনি। শুধু মাইকে যখন ঘোষণা হয়, “ইচ্ছুক-অনিচ্ছুক নির্বিশেষে চাষিদের এককালীন ৭ লক্ষ টাকা এবং মাসে ৭ হাজার টাকা আর্থিক সাহায্য দেওয়া হোক”, তখন আন্দোলনকারীদের সঙ্গে তৃণমূলের লোকজনের তর্কাতর্কি বাধে। পুলিশ ও স্থানীয় তৃণমূল নেতৃত্বের হস্তক্ষেপে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়। দলের বারণ শুনে সিপিএম নেতা আব্দুর রেজ্জাক মোল্লা এ দিন সিঙ্গুরে আসেননি।
বস্তুত, ২০০৬ সাল থেকে টানা আন্দোলনে সিঙ্গুরবাসী যে ‘ক্লান্ত’, তা তৃণমূল-সহ অন্য রাজনৈতিক দলের অজানা নয়। হাইকোর্টের রায়ের পর থেকে সিঙ্গুরে তবু আন্দোলন কর্মসূচির বিরাম নেই। শাসক দল তৃণমূল যেমন আন্দোলন করছে, করছে তাদের জোটসঙ্গী কংগ্রেসও।
সিঙ্গুর কৃষিজমি রক্ষা কমিটির নেতা তথা হরিপালের তৃণমূল বিধায়ক বেচারাম মান্না অবশ্য বলছেন, “শুধু আন্দোলন নয়, সিঙ্গুরের অনিচ্ছুক জমিহারাদের জন্য সরকারি সাহায্য জরুরি ছিল। সরকার তাঁদের পাশে দাঁড়িয়ে সেটাই করছে। ওঁরা এত দিন আন্দোলন করেছেন। এখন সরকার তাঁদের হয়ে লড়ছে।” নকশালপন্থীদের রাজনৈতিক ‘কর্মকাণ্ডের’ প্রতি তাঁর কটাক্ষ, “অনেক পরিযায়ী পাখি এখন আসছে। কিন্তু আমরা বরাবর সিঙ্গুরের মানুষের পাশে থেকেছি।”
মিছিলে সামিল হলে অনিচ্ছুক চাষিরা সরকারি সাহায্যের চাল-টাকা পাবেন না—এমন হুমকি দেওয়া হয়েছে বলেও অভিযোগ করেছে লিবারেশন। অভিযোগ উড়িয়ে বেচারামবাবু বলেন, “ওরা লোক জোগাড় করতে না পেরে এখন এ সব ভুল ব্যাখ্যা খাড়া করছে।” আর এলাকার এক তৃণমূল নেতার কথায়, “কয়েক মাস ধরে পঞ্চায়েতকে সঙ্গে নিয়ে দিনরাত এক করে আমাদের কর্মীরা সরকারি সাহায্যপ্রাপকদের তালিকা তৈরি করেছেন। তখন এঁরা কোথায় ছিলেন?”
সিঙ্গুরে ‘ইচ্ছুক-অনিচ্ছুক’ নির্বিশেষে আর্থিক সাহায্যের দাবি তোলার পরেও ‘ইচ্ছুক’দের সাড়া মিলল না কেন? সাহানাপাড়ার দেবপ্রসাদ দাস আড়াই বিঘে জমি বিক্রির টাকা পেয়েছিলেন। প্রশিক্ষণ নেওয়ার পরে চাকরি পাওয়ার কথা ছিল ছেলের। প্রকল্প না হওয়ায় সে আশাও পূরণ হয়নি। বললেন, “জমা টাকা শেষ। ভাগ্যে কী আছে, কে জানে! মিছিল করে তো প্রকল্প ফিরে আসবে না!”
ভবিষ্যৎই যেখানে অনিশ্চিত, সেখানে আন্দোলনে সামিল হয়ে আর কী হবে? এত দিনের ঝড়-ঝাপটায় এই সার সত্যটা বুঝে গিয়েছে সিঙ্গুর!



First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.