সিঙ্গুরে অধিগৃহীত জমি প্রত্যর্পণ সংক্রান্ত আইন লইয়া রাজ্য সরকার এবং টাটা গোষ্ঠীর মধ্যে বিবাদে ফল এখন ১-১ তৃণমূল কংগ্রেসের বিধায়ক তথা সিঙ্গুর মামলার অন্যতম আইনজীবী কল্যাণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের এই মন্তব্যে যে মানসিকতা প্রতিফলিত হইয়াছে তাহা লইয়া প্রশ্ন থাকিতে পারে, কিন্তু মন্তব্যটি অহেতুক নয়। হাইকোর্টের প্রথম মামলায় রায় সরকারের পক্ষে গিয়াছিল, দ্বিতীয় তথা পরবর্তী পর্যায়ের মামলায় রায় সরকারের বিপক্ষে গিয়াছে। এবং, ইহা আবশ্যিক ভাবে চূড়ান্ত পর্ব নয়, কারণ সুপ্রিম কোর্টের পথ সরকারের সামনে খোলা আছে। সুতরাং ‘ফল অমীমাংসিত’ বলিলে ভুল হইবে না। তবে সরকার পক্ষ, বিশেষত সেই পক্ষের ব্যবহারজীবীরা নিশ্চয়ই জানেন, আইন প্রণয়নে যে বিচক্ষণতার প্রয়োজন ছিল, তাহার অভাব ঘটিয়াছে। হাইকোর্টের ডিভিশন বেঞ্চের রায়ে সেই ত্রুটি স্পষ্ট এবং রীতিমত কঠোর ভাষায় চিহ্নিত। মুখ্যমন্ত্রী এবং তাঁহার অনুগামীরা দরিদ্র মানুষের জন্য লড়াইয়ের প্রতি তাঁহাদের দায়বদ্ধতার কথা বলিয়াছেন। ‘মা মাটি মানুষ’-এর মঙ্গলচিন্তার সহিত কিন্তু প্রশাসনিক দক্ষতার কোনও বিরোধ নাই। বামফ্রন্ট সরকার বহু বিষয়েই আপন অদক্ষতার পরিচয় দিয়া গিয়াছে। নূতন সরকারও সেই একই ধারার ধারক হইলে বুঝিতে হইবে, পশ্চিমবঙ্গ সত্যই দুর্ভাগা।
কিন্তু মামলার ফল কী হইয়াছে এবং কী হইবে, পশ্চিমবঙ্গের অর্থনীতির পক্ষে তাহা নিতান্তই গৌণ প্রশ্ন। মুখ্য প্রশ্নটি সাধারণ ভাবে রাজ্যের শিল্পায়ন এবং বিশেষত শিল্পের জন্য প্রয়োজনীয় জমির সংস্থান লইয়া। রাজ্যের উন্নয়নের কথা ভাবিতে চাহিলে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে এই প্রশ্নের মুখোমুখি দাঁড়াইতেই হইবে। হাইকোর্টের রায়দানের পরেই মুখ্যমন্ত্রী সিঙ্গুরের ‘অনিচ্ছুক’ কৃষকদের পাশে দাঁড়াইয়াছেন। তাঁহার রাজনীতি তাঁহাকে দাঁড়াইতে বাধ্য করিয়াছে ‘অনিচ্ছুক’ কৃষকই তাঁহার নির্বাচনী সাফল্যের প্রাথমিক মূলধন ছিল। কিন্তু তাঁহাকে বৌদ্ধ দর্শনের সেই প্রবচনটির কথা স্মরণ করাইয়া দেওয়া যাইতে পারে: প্রত্যেক মানুষ স্বর্গের দ্বার খুলিবার একটি চাবি হাতে পায়, একই চাবি দিয়া নরকের দ্বার খোলা যায়। যে জমি অধিগ্রহণের রাজনীতি বিরোধী নেত্রীকে ক্ষমতার গদিতে বসাইয়াছে, তাহাই এখন মুখ্যমন্ত্রীর পথের কাঁটা। ওই রাজনীতির কারণেই তাঁহার সম্পর্কে শিল্পবাণিজ্য মহলের সংশয় ছিল। সরকার গঠনের এক বছরের মধ্যেই সেই সংশয় দূর হইবার বদলে ঘনীভূত হইয়াছে।
সমস্যাটি মৌলিক। শিল্পের জন্য জমি চাই। পশ্চিমবঙ্গ গুজরাত বা রাজস্থান নয়, এমনকী চিনও নয়, এখানে জমি বলিতে প্রধানত কৃষিজমি। তদুপরি অধিকাংশ ক্ষেত্রেই জমির মালিকানা অতি খণ্ডিত, এবং বামফ্রন্টের অতুল কীর্তি ‘অপারেশন বর্গা’র কল্যাণে জমির উপর মালিক অপেক্ষা বর্গাদারের কর্তৃত্বই সমধিক। ফলে শিল্পের জন্য জমি অধিগ্রহণ ভিন্ন বাস্তব উপায় নাই, প্রয়োজনে আইনের শক্তি প্রয়োগ করিয়াই সেই অধিগ্রহণ সম্পন্ন করিতে হইবে। তাহার জন্য যথেষ্ট ক্ষতিপূরণ দেওয়ার যুক্তি আছে, সেই ক্ষতিপূরণের সুবিধা উদার ভাবে প্রসারিত করিবারও যুক্তি আছে, সে জন্য গণতান্ত্রিক উপায়ে সরকারের উপর চাপ সৃষ্টিও নিশ্চয়ই সদর্থক রাজনীতির একটি কর্তব্য। কিন্তু প্রয়োজনে কৃষিজমি লইতে হইবে, জমির মালিক বা কৃষকরা অনিচ্ছুক হইলেও। এই বড় সত্যটিকে স্বীকার করিতে হইলে মুখ্যমন্ত্রী তথা তাঁহার দলের কর্তব্য আপন নির্বাচনী স্লোগান এবং ইস্তাহারের নাগপাশ হইতে নিজেদের মুক্ত করা। পশ্চিমবঙ্গের দুর্ভাগ্য, তাহার পরিবর্তে তাঁহারা সিঙ্গুরের চোরাবালিকেই আশ্রয় করিয়াছেন। হাইকোর্টের রায় তাঁহাদের একটি সুযোগ দিয়াছে। ভ্রান্ত এবং নেতিসর্বস্ব অতীতকে বিদায় জানাইয়া উন্নয়নের নূতন ভবিষ্যৎ রচনার সুযোগ। কিন্তু, রাজনীতি বড় বালাই। |