ভিন্ রাজ্যের ইউনিয়নের আন্দোলনের জেরে গত কয়েক মাস ধরে বারবার কলকাতার একাধিক নামী বেসরকারি হাসপাতালের পরিষেবা বিপর্যস্ত হওয়ার অভিযোগ উঠেছে। মূলত দক্ষিণ ভারতের বিভিন্ন রাজ্য থেকে আসা নার্সদের বড় অংশ এই ইউনিয়নের সদস্য। হাসপাতালগুলির অভিযোগ, ওই ইউনিয়নই নার্সদের ধর্মঘটে ইন্ধন জোগাচ্ছে। কলকাতার বেসরকারি হাসপাতালের নার্সদের ৮০ শতাংশই দক্ষিণ ভারতের রাজ্য থেকে আসেন। অভিযোগ, সংগঠনের কথায় তাঁরা কাজ বন্ধ করে দিচ্ছেন, ধর্নায় বসছেন, আইসিইউ ছেড়ে নেমে আসছেন, গণছুটিও নিচ্ছেন। ‘ইন্ডিয়ান রেজিস্টার্ড নার্সেস অ্যাসোসিয়েশন’ (আইআরএনএ) নামে একটি সংগঠনই এই আন্দোলন-ধর্মঘটে উস্কানি দিচ্ছে বলে অভিযোগ করেছেন শহরের বিভিন্ন বেসরকারি হাসপাতালের কর্তৃপক্ষ। এর সদর দফতর কেরলের কোচিতে। দিল্লিতেও দফতর রয়েছে। সংগঠনে কংগ্রেস ও বাম উভয় রাজনৈতিক দলের প্রাধান্যই রয়েছে। ফলে প্রশাসনিক ও রাজনৈতিক মহলের একাংশ এর মধ্যে ‘অন্য’ রাজনীতি দেখছেন। ভিন্ রাজ্যের নার্সরা এ রাজ্যের হাসপাতালে কাজ করতে আসছেন বিগত প্রায় ১৫-২০ বছর ধরে। প্রশ্ন উঠেছে, এত দিন এখানকার হাসপাতালে তাঁদের ‘অধিকার হরণ’ নিয়ে কেন অভিযোগ তোলেনি ওই সংগঠন?
রাজ্যে এই প্রথম ক্ষমতায় তৃণমূল, বিরোধী আসনে বামেরা। কংগ্রেসের সঙ্গেও তৃণমূলের টানাপোড়েন তুঙ্গে। ঠিক এই পরিস্থিতিতে এখানে আইআরএনএ-র নার্সদের আন্দোলন সবচেয়ে জোরাল হওয়ায় প্রশাসন ও স্বাস্থ্যকর্তাদের একাংশ রাজনৈতিক সমীকরণ প্রসঙ্গ উড়িয়ে দিচ্ছেন না। আইআরএনএ-র মুখপাত্র অজয়কুমার পিল্লাইয়ের অবশ্য সাফাই, “আমাদের শক্তি সঞ্চয় করতে সময় লেগেছে। পশ্চিমবঙ্গে এসে আন্দোলনের জমি তৈরি করতেও সময় গিয়েছে।”
রাজনীতি থাকুক বা না-ই থাকুক, বেসরকারি হাসপাতাল কর্তৃপক্ষদের ক্ষোভ, তাঁদের পরিষেবায় বারবার ধাক্কা লাগছে দেখেও স্বাস্থ্য দফতর কেন নীরব? স্বাস্থ্য প্রতিমন্ত্রী চন্দ্রিমা ভট্টাচার্যের উত্তর, “বেসরকারি হাসপাতালগুলিতে সরকারের নিয়ন্ত্রণ নেই। একমাত্র ক্লিনিক্যাল এস্ট্যাবলিশমেন্ট আইন ভঙ্গ করলে তাদের লাইসেন্স আমরা বাজেয়াপ্ত করতে পারি। কিন্তু নার্স বা কর্মীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে পারি না।”
কিছু দিন আগেই মাইনে বাড়ানো ও কাজের সঠিক বিভাজনের দাবি তুলে কাজ বন্ধ করে দেন আলিপুরের একটি হাসপাতালের ভিন্ রাজ্যের নার্সরা। তাঁরা সকলেই ওই আইআরএনএ-র সদস্য। গত সপ্তাহে বাইপাসের ধারের একটি হাসপাতালে টানা তিন-চার দিন কাজে আসেননি ভিন্ রাজ্যের নার্সরা। নার্সের অভাবে সারাদিন প্রায় বিনা-পরিষেবায় থেকে শারীরিক অবস্থার অবনতি ঘটে বাঘাযতীনের বাসিন্দা সত্তরোর্ধ্ব কল্পনা নাগের। শ্বাসকষ্টের রোগী কল্পনাদেবীর বাড়ির লোক এ ব্যাপারে হাসপাতালে ও স্বাস্থ্যভবনে লিখিত অভিযোগ জানিয়েছেন।
ভুক্তভোগী শহরের বিভিন্ন বেসরকারি হাসপাতালের সুপার সিঞ্চন ভট্টাচার্য, স্বরাজব্রত পুরকায়স্থ, তাপস ঘোষ, চিরন্তন বসুদের অভিযোগ, রোগীদের সামান্য বেডপ্যান দিতে বললেও ওই নার্সরা এখন জানাচ্ছেন, তাঁদের অতিরিক্ত খাটানো হচ্ছে। জোট বেঁধে কাজ বন্ধ করে দিচ্ছেন তাঁরা। এক-এক বারে ২৫-৩০ হাজার টাকা করে মাইনে বাড়ানোর দাবিতে আইসিইউ-এর কাজ ছেড়ে বেরিয়ে আসছেন সকলে। গণছুটিও নিচ্ছেন।
ভিন্ রাজ্যের নার্সদের তরফে অজয়কুমার পিল্লাইয়ের পাল্টা অভিযোগ, “কলকাতার বেশ কিছু বেসরকারি হাসপাতালে এত দিন অন্য রাজ্যের নার্সদের নামমাত্র মাইনেতে, বিনা ছুটিতে খাটানো হত। এঁদের ন্যূনতম মাইনের কোনও ঠিক ছিল না। আমরা তাঁদের অধিকার বুঝতে শেখাচ্ছি বলেই এখন এই হাসপাতালগুলির সমস্যা হচ্ছে। দরকার পড়লে ওই সব হাসপাতালে লাগাতার ধর্মঘট চালানো হবে।” |