পাঁচ মাসের অন্তঃসত্ত্বা বছর তিরিশের সুদীপ্তা। হঠাৎ এক দিন সকালে ঘুম থেকে উঠে দেখলেন, মাথায় বেশ খানিকটা অংশ থেকে সব চুল উধাও। চিকিৎসক জানালেন, অন্তঃসত্ত্বা অবস্থায় অতিরিক্ত উদ্বেগ থেকেই এমন সমস্যার দেখা দিয়েছে।
মাধ্যমিক পরীক্ষা শুরু হওয়ার দিন কয়েক আগে হঠাৎ এক দিন রনির নজরে পড়ল, মাথার পিছন দিকে বেশ খানিকটা জায়গায় কোনও চুল নেই। বেরিয়ে এসেছে মসৃণ চামড়া। উদ্বিগ্ন বাবা-মা চিকিৎসকের কাছে নিয়ে গিয়ে জানতে পারলেন, এ ক্ষেত্রেও সমস্যার মূল অতিরিক্ত মানসিক চাপ।
ডাক্তারি পরিভাষায় এই সমস্যার নাম ‘অ্যালোপেশিয়া এরিয়েটা’। হঠাৎ এক রাতে মাথার সব চুল সাদা হয়ে যাওয়া বা মাথার বেশ খানিকটা অংশ থেকে সব চুল একসঙ্গে উপড়ে আসা, এই রোগের উপসর্গ। রোজের জীবনে বাড়তে থাকা মানসিক চাপ এমন
বিভিন্ন ধরনের চর্মরোগ বাড়াচ্ছে বলে মত ডাক্তারদের।
স্ট্রেসের কারণে স্থূলতা, ডায়াবিটিস, হার্টের সমস্যা বেড়ে যাওয়ার ঘটনা এখন যথেষ্টই পরিচিত শহুরে মানুষের কাছে। তবে বাড়তে থাকা মানসিক চাপ এখন হয়ে উঠছে আরও নানা ধরনের শারীরিক অসুস্থতার কারণ। যার মধ্যে ত্বক ও চুলের সমস্যাও অন্যতম বলেই মত চিকিৎসক মহলে। চর্মরোগের চিকিৎসক সন্দীপন ধর জানালেন, মানসিক চাপের সঙ্গে জড়িত চর্মরোগ এখন ছোট-বড় সকলের ক্ষেত্রেই খুব দেখা যাচ্ছে। তিনি বলেন, “ওষুধের পাশাপাশি বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই কাউন্সেলিংয়ের প্রয়োজন হয় রোগীকে সুস্থ করতে। রোগীদের মনোবিদদের সঙ্গে যোগাযোগ করতে বলা হয়।”
এ ছাড়াও ত্বক সংক্রান্ত আরও নানা ধরনের সমস্যা দেখা দিতে পারে মানসিক চাপ থেকে। তার মধ্যে এখন ‘সোরিয়াসিস’, ‘একজিমা’ এবং ‘লিনকেন প্ল্যানাস’-এর মতো রোগ সব চেয়ে বেশি দেখা যাচ্ছে বলে জানাচ্ছেন চিকিৎসকেরা। কোনও ক্ষেত্রে সারা শরীর ছেয়ে যায় বেগুনি রঙের ছোট ছোট দানায় তো কখনও কখনও হাতে-পায়ে মাছের আঁশের মতো ধূসর রঙের দাগ থেকে শুরু হয় অসম্ভব অস্বস্তি। ভিটিলিগো অথবা শ্বেতীও অনেক সময়ে বাড়ে অতিরিক্ত মানসিক চাপ থেকে।
আর এক চর্মরোগ চিকিৎসক সঞ্জয় ঘোষ বলেন, “ত্বকের এই ধরনের রোগগুলিকে বলে অটো-ইমিউন ডিজিজ। স্ট্রেস থেকে কেন্দ্রীয় স্নায়ুতন্ত্রের কিছু পরিবর্তন হয়, সেটা অনেক সময়ে অটো-ইমিউন রোগকে প্রভাবিত করে।” তবে মানসিক চাপের পাশাপাশি খাওয়া-দাওয়ার অভ্যাস এবং দূষণের মাত্রাও এই সব রোগ বাড়ার পিছনে উল্লেখযোগ্য কারণ। সঞ্জয়বাবু জানিয়েছেন, রোজ যে সব রাসায়নিক প্রসাধনী দ্রব্য ব্যবহার করা হয়, তার থেকেও ত্বক সংক্রান্ত বিভিন্ন অসুখ হতে পারে। তবে উদ্বেগ থেকে ভীষণ ভাবে বেড়ে যায় এই সব অসুখ। তাঁর কথায়, “এই ধরনের চর্মরোগগুলিকে তাই ‘লাইফস্টাইল ডিজিজ’ বলা হয়। শহুরে জীবনযাত্রায় গতি যত বাড়ছে, এই ধরনের রোগীর সংখ্যাও তত বেশি পাচ্ছি।”
এ বিষয়ে একমত সন্দীপনবাবুও। তিনি জানান, ইউরোপ-আমেরিকায় জনসংখ্যার একটা বিশাল অংশ প্রায় গত কুড়ি বছর ধরে এমন নানা সমস্যায় ভুগছে। এখানে সোরিয়াসিস, অ্যালোপেশিয়া, একজিমা, ভিটিলিগোর রোগীর সংখ্যা গত পাঁচ বছরে উল্লেখযোগ্য ভাবে বেড়ে গিয়েছে। এবং এঁদের অধিকাংশের রোগের কারণই মানসিক চাপ।
মনে চাপ পড়ার কারণে শারীরিক অসুস্থতা নতুন ঘটনা নয়। তবে এখন নিজের ‘ভাবমূর্তি’ নিয়ে শহুরে মানুষ এত বেশি চিন্তিত যে, তা সমস্যার কারণ হয়ে দাঁড়াচ্ছে বলে মনে করেন মনোবিদ নীলাঞ্জনা সান্যাল। তাঁর কথায়, “মানসিক কোনও সমস্যার কথা এখনও অন্যকে বলতে স্বচ্ছন্দ নন বেশির ভাগ মানুষ। চেপে রাখার চেষ্টা করলে সমস্যাটা হয়তো অবচেতন স্তরে চলে যায়। কিন্তু সেটা থেকে যায়। সেই সমস্যাগুলিই পরে ফুটে ওঠে শরীরের কোনও অংশে। ত্বক তার মধ্যে অন্যতম।”
তাই এই ধরনের রোগের ক্ষেত্রে ওষুধের পাশাপাশি যোগ ব্যায়াম বা ধ্যান করার কথা বলে থাকেন চিকিৎসকেরা। কারণ ‘স্ট্রেস ম্যানেজমেন্ট’ ভাল ভাবে করা না গেলে এই সমস্যা নির্মূল করা অসম্ভব বলেই মনে করেন বিশেষজ্ঞেরা। |