|
|
|
|
পঞ্চায়েতের অঙ্কে অস্বস্তি দু’পক্ষেই |
অপরিবর্তিত দাসপুরে ‘উহ্য’ই সূর্যকান্ত, শুভেন্দু |
বরুণ দে • মেদিনীপুর |
দাসপুরের উপ-নির্বাচন থেকে ‘ঘুরে দাঁড়ানো’র অক্সিজেন পেল না সিপিএম। প্রায় ১৯ হাজার ভোটে হারতে হল দলীয় প্রার্থী, ‘নতুন মুখ’ সমর মুখোপাধ্যায়কে। যদিও প্রাথমিক ভাবে ফলাফল পর্যালোচনা করে দলের পশ্চিম মেদিনীপুর জেলা নেতৃত্বের দাবি, এই ফল আশানুরূপ নয় ঠিকই, তবে হতাশাজনকও নয়। সিপিএমের এক জেলা-নেতার বক্তব্য, “তৃণমূলের জয়ের ব্যবধান কমেছে। তৃণমূল নেতৃত্ব দাবি করেছিলেন, গত এক বছরে রাজ্য সরকারের কাজকর্ম দেখে মানুষ খুশি। এর ফলে তাঁদের নাকি সমর্থন বাড়বে। উপ-নির্বাচনের ফল কিন্তু সে-কথা বলছে না। বরং তৃণমূল এ বার প্রায় ৩ শতাংশ ভোট কম পেয়েছে।”
অন্য দিকে, জেলা তৃণমূল নেতাদের দাবি, ভোটদানের সার্বিক হার কমাতেই সামান্য ভোট কমেছে। বরং ঘুরে দাঁড়াতে গিয়ে সিপিএমের ভোটই আরও ১ শতাংশ নেমেছে। দলীয় কোন্দল, প্রতিষ্ঠান-বিরোধিতা সামলে দলের সর্বময় নেত্রীর মনোনীত প্রার্থী মমতা ভুঁইয়াকে জিতিয়ে আনতে পারা দলের মধ্যে, বিশেষত মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়-মুকুল রায়দের কাছে, তাঁদের নিজেদের অবস্থানও দৃঢ় করবে বলে আশা জেলা তৃণমূল নেতাদের। মোটের উপর এক বছর আগের বিধানসভা নির্বাচনের ফলাফলের থেকে ফারাক খুব একটা কিছু হয়নি এই উপ-নির্বাচনে। কোনও শিবিরেই ‘বাড়তি’ আশা জোগাতে বা হতাশা তৈরি করতে পারছে না এই ফল। তবে, উপ-নির্বাচনে সিপিএম বা তৃণমূলকোনও পক্ষই যে দলগত ঐক্যের ছবি তুলে ধরতে পারেনি, সে কথা বলছেন দু’দলের সাধারণ কর্মী থেকে শুরু করে রাজনৈতিক বিশ্লেষকরাও। পঞ্চায়েত ভোটের আগে যেটা ‘স্বাস্থ্যকর লক্ষণ নয়’ বলেই মনে করছেন দু’দলের কর্মী-সমর্থকেরা।
সিপিএম জেলা-নেতৃত্ব ‘ঘুরে দাঁড়াতে’ মরিয়া হয়েও এই জেলারই মানুষ, বিধানসভায় বিরোধী দলনেতা তথা দলের পলিটব্যুরো সদস্য সূর্যকান্ত মিশ্রকে দাসপুরের উপ-নির্বাচনী প্রক্রিয়ায় কোনও ভাবে যুক্ত করেননি। গত এক বছরে রাজ্যে সিপিএমের অন্যতম জনপ্রিয় মুখ হয়ে ওঠা সূর্যকান্তবাবুকে কিন্তু বাঁকুড়া সদরের উপ-নির্বাচনেও প্রচার-সভা করতে দেখা গিয়েছে। দাসপুরে দেখা যায়নি। জেলা সিপিএম নেতৃত্বের সঙ্গে সূর্যকান্তবাবুর ‘দূরত্ব’ যে এই পর্বেও মেটেনি, তারই ইঙ্গিতবাহী বলে এই ঘটনাকে ব্যাখ্যা করছে রাজনৈতিক মহল। বিপর্যয় ঝেড়ে ‘ঘুরে দাঁড়ানো’র লড়াইয়ের মধ্যেও গোষ্ঠী-রাজনীতি থেকে জেলা সিপিএমের মুক্ত হতে না-পারা দাসপুরে তাদের ‘আশানুরূপ ফল না-হওয়া’রও অন্যতম কারণ বলে মনে করছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা। তবে, জেলা সিপিএমের ক্ষমতাসীন নেতাদের ব্যাখ্যা, দাসপুরে কোনও সভা-সমাবেশই করা হয়নি। ফলে ‘ব্যস্ত’ সূর্যকান্তবাবুকে ডাকার সুযোগই আসেনি!
অন্য দিকে, গত বছর বিধানসভা-ভোটেও এই জেলায় অত্যন্ত ‘সক্রিয়’ যুব তৃণমূলের রাজ্য সভাপতি শুভেন্দু অধিকারীও দূরে সরে থেকেছেন দাসপুরের উপ-নির্বাচন থেকে। হলদিয়া পুরোভোটে বিরোধীশূন্য বোর্ড গড়ার দাবি করেও পর্যুদস্ত শুভেন্দু নিজেকে অনেকটাই গুটিয়ে ফেলেছেন বলে তৃণমূল সূত্রের খবর। তাই, প্রচারে আসার কথা থাকলেও দাসপুরে আসেননি। পশ্চিম মেদিনীপুর জেলা তৃণমূল নেতৃত্বের সঙ্গে শুভেন্দুর বিরোধও অবশ্য গোপন নয়। যুব-তৃণমূলের রাজ্য সভাপতির অনুগামীরা এই জেলায় সমান্তরাল সাংগঠনিক কাঠামো গড়ে তুলতে চাইছেন বলেও অনেক আগে থেকেই দলের মধ্যে অভিযোগ রয়েছে। ফলে, দাসপুরের প্রচারে শুভেন্দুর ‘উহ্য’ থেকে যাওয়া মনে মনে খুশিই করেছে জেলা-তৃণমূল নেতৃত্বের একাংশকে। তাঁদের দাবি, তাঁরা প্রমাণ করেছেন নিজেদের যোগ্যতা।
কিন্তু সেই ‘যোগ্যতা’ ত্রিস্তর পঞ্চায়েতে এখনও অটুট বাম-নিয়ন্ত্রণ আলগা করতে পারবে কিএখন সেটাই ‘চ্যালেঞ্জ’ জেলা তৃণমূলের। পশ্চিম মেদিনীপুর এক সময়ে সিপিএমের ‘লাল-দুর্গ’ বলেই পরিচিত ছিল। কিন্তু গত বছরের বিধানসভা ভোটে বাকি রাজ্যের সঙ্গেই পশ্চিম মেদিনীপুরেও বিপর্যয় ঘটে বামেদের। সিপিএম-সংগঠনেও ধস নামে। জেলার একের পর এক এলাকায় প্রভাব বাড়তে থাকে তৃণমূলের। বছর ঘুরতেই জেলা সিপিএম নেতৃত্ব অবশ্য বলতে শুরু করেন, ‘নজিরবিহীন প্রতিকূলতার মধ্যেও প্রাথমিক বিহ্বলতা কাটিয়ে কমরেডরা ধৈর্য্য সহকারে রাজনৈতিক পরিস্থিতির চাহিদা অনুযায়ী কার্যক্রম চালিয়ে ধীরে ধীরে ঘুরে দাঁড়াচ্ছেন। ঘুরে দাঁড়ানোর এই প্রচেষ্টাকে অব্যাহত রেখে এগিয়ে যেতে হবে’ (পার্টি-চিঠি ১/২০১২)। কিন্তু ঘুরে দাঁড়ানো কি সত্যিই সম্ভব হচ্ছে? দাসপুরের উপ-নির্বাচন ছিল তারই পরীক্ষা। ফলাফল থেকে স্পষ্ট, সিপিএমের পক্ষে অনুকূল সময় বোধহয় এখনও হাজির হয়নি। এই অবস্থায় পঞ্চায়েত ভোট নিয়ে স্বভাবতই বাড়তি উদ্বেগ তৈরি হচ্ছে বাম-শিবিরে।
দাসপুরে উতরোলেও এই ভোটেরই কয়েক দিন আগে পর্যন্ত চলা তীব্র গোষ্ঠী-কোন্দলের মতো পরিস্থিতি চলতে থাকলে ত্রি-স্তর পঞ্চায়েত নির্বাচনে যে ‘সমস্যা’ হবে, সেই পর্যালোচনা উঠে আসছে তৃণমূল-শিবিরেও। ফলে, শাসকদলও খুব স্বস্তিতে নেই। তার উপর রাষ্ট্রপতি পদ-প্রার্থী মনোনয়ন নিয়ে কংগ্রেসের সঙ্গে দলের সম্পর্ক যে ভাবে তলানিতে গিয়ে ঠেকল এবং জোট সত্যিই ভেঙে গেলে সমস্যা যে আরও বাড়বে, তা-ও মনে করছেন তৃণমূলের একটা বড় অংশ। দাসপুর নিয়ে তাদের উচ্ছ্বাসও তাই বাঁধভাঙা হচ্ছে না।
|
|
|
|
|
|