বঙ্গে বাণিজ্য
‘সত্য’দৃষ্টির সন্ধানে
বাবার অমতে ব্রাহ্ম ধর্ম গ্রহণের জন্য বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল উত্তর কলকাতার শ্রীমানী পরিবারের ছেলে হরিদাস শ্রীমানী। সুকিয়া স্ট্রিটের শ্রীমানী বাড়ি ছেড়ে তিনি শ্যামবাজারের ভাড়া বাড়িতে থাকতে শুরু করেন। বেকার, গৃহহীন হরিদাসকে সে সময় সাহায্য করতে এগিয়ে এসেছিলেন কেশবচন্দ্র সেন এবং দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর। মূলত তাঁদের অনুপ্রেরণা ও সহযোগিতায়ই ১৮৬১-তে ১ ধর্মতলা স্ট্রিটে একটি চশমার দোকান খুলে বসলেন হরিদাস। দোকানের নামও রাখলেন তাঁর নিজের নামেই। অল্প দিনের মধ্যেই দোকানটি জনপ্রিয় হয়ে উঠল।
ওই দোকানটাই সম্ভবত কলকাতার প্রথম বাঙালি চশমার দোকান, এমনই দাবি হরিদাস শ্রীমানীর বর্তমান প্রজন্মের। হরিদাসের ছেলে সত্যভূষণ ওই ব্যবসা বাড়াতে নিজে অপটোমেট্রি অধ্যয়ন করলেন। অপ্টোমেট্রিস্ট সত্যভূষণ বাবার ব্যবসার প্রসার ঘটালেন। ব্যবসা বাড়াতে তিনি সাইকেলে চেপে কলকাতা ও শহরতলির বাড়ি বাড়ি ঘুরে চোখ পরীক্ষা ও চশমার ব্যবস্থাপত্র দিতেন। সাধারণ মানুষকে আর ধর্মতলায় আসতে হত না। বাড়ি বসেই চোখের রোগের চিকিৎসা এবং চশমা পেয়ে যেতেন। দেশি চশমার পাশাপাশি সে যুগের নানা নামী বিদেশি কোম্পানির চশমার ডিলারশিপও সে সময়ে হরিদাস শ্রীমানীর দোকানে ছিল। তত দিনে হরিদাসবাবু ভাড়া বাড়ি ছেড়ে উঠে গিয়েছেন শ্যামপুকুর এলাকায় শ্রীকৃষ্ণ লেনের নিজের বাড়িতে। ১৯১১-এ ওই বাড়িতেই ৮০ বছর বয়সে মারা যান হরিদাসবাবু।
সত্যভূষণের হাত ধরে ব্যবসা যখন মধ্যগগনে সেই সময় ১৯১৭ সালে হাজরার মোড়ে চারতলা বাড়ি তৈরি করেন সত্যভূষণ। সেখানেই উঠে আসেন তিনি। দোকানটি কিন্তু থেকে যায় ১, ধর্মতলা স্ট্রিটেই। এখানেই রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুরেরা চোখ দেখাতে আসতেন। কিন্তু সত্যভূষণের মৃত্যুর পরে দোকানটির আভিজাত্য ক্ষয় হতে শুরু করে।
আসলে সত্যভূষণ যে জায়গায় দোকানের জনপ্রিয়তা ও বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়ে গিয়েছিলেন পরের প্রজন্ম সেই ধারাটি তেমন ভাবে বজায় রাখতে পারেননি। তার ফলে কৌলিন্য কিছুটা কমে গিয়েছিল। এর পরে সত্যভূষণের ছোট ছেলে শম্ভুনাথ ব্যবসার হাল ধরেন। ১৯৮৪-এ তিনি দোকানটিকে নিয়ে আসেন হাজরা মোড়ের বাড়ির একতলায়। ‘হরিদাস শ্রীমানী’ পরিবর্তিত হয় ‘শ্রীমানী আই কেয়ার’-এ। সত্যভূষণের পরে পরিবারের কেউই অপটোমেট্রি চর্চা করেননি। ফলে হাজরার দোকানেই চিকিৎসক বসিয়ে চোখ পরীক্ষা শুরু হল।
যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে মানানসই পরিবর্তনও হয়েছে দোকানটির। চক্ষু পরীক্ষায় ব্যবহার হয় আধুনিক যন্ত্রপাতি। বর্তমান কর্ণধার গৌতম শ্রীমানী বলেন, ‘‘হরিদাস শ্রীমানী ছিল সে যুগের প্রথম বাঙালির চশমার দোকান। রবীন্দ্রনাথ, চিত্তরঞ্জন দাশেরা আমাদের দোকানের তৈরি চশমা পরতেন। এখনও অনেক জননেতা, বিশিষ্ট মানুষ আমাদের দোকান থেকেই চশমা তৈরি করেন।”
শুধু ব্যবসাই নয়, রাজ্যের দরিদ্র মানুষের জন্য তাঁরা বিনা পয়সায় চক্ষুপরীক্ষাশিবির এবং চশমা বিতরণ করে থাকেন বলেও দাবি গৌতমবাবুর। সন্ধ্যায় দোকানে তখন উপচে পড়া ভিড়। ক্রেতা সামলাতে সামলাতেই গৌতমবাবু বললেন, “ভারত সেবাশ্রম সঙ্ঘ-এর সঙ্গে যৌথ উদ্যোগে হুগলি জেলার গ্রামে গ্রামে দুঃস্থদের চক্ষু-পরীক্ষা, চশমা দেওয়ার মতো কাজ করি। এতে অন্য এক রকম আনন্দ পাই।’’




অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.