প্রতি পক্ষ
নও শুধু ছবি
ই পক্ষে ছিল তাঁর প্রয়াণদিবস। ১১ জুন। অর্ধশতাব্দী আগে, ১৯৬২-র এই দিনটিতে একটি দুর্ঘটনায় স্তব্ধ হয়েছিলেন তিনি। চিরকালের মতো। বিহ্বল
ছবি: পরিমল গোস্বামী
বাঙালি সহসা বুঝতে পারেনি, ঠিক কতটা ক্ষতি হয়ে গেল! পরে, বাংলা ছবির পরিমণ্ডলে ক্রমাগত বেড়েছে শূন্যতা। তিনি না-থাকার শূন্যতা! স্বভাবসিদ্ধ সংক্ষিপ্ত বাচনে সত্যজিৎ রায় বলেছিলেন, বাংলা ছবিতে আর মধ্যবয়সী, অভিজাত বাঙালি পুরুষের কথা ভাবা যাবে না।
শুনলে তিনি, শচীন্দ্রনাথ বিশ্বাস, অন্য (এবং প্রসিদ্ধ) নামে ‘ছবি বিশ্বাস’, মৃদু হাসতেন হয়তো। অথচ, ইতিহাস প্রমাণ করেছে, ছবি বিশ্বাস তাঁর জীবদ্দশাতেই নিছকই এক চরিত্রাভিনেতা থেকে একটি বিশিষ্ট রূপকল্পে পরিণত হয়েছিলেন।
ছবি বিশ্বাস বললেই একটি বিশেষ উচ্চতা, জলদগম্ভীর স্বর, একটি চাহনি, পদক্ষেপের বিশিষ্ট ধরন। সব মিলিয়ে, বাঙালির কল্পনায় তিনি স্বয়ং একটি ‘টাইপ’!
ছাঁচ থাকলে তার ব্যবহার এবং অপব্যবহার দুইই সম্ভব। ফলে, ছবি বিশ্বাস একের পর এক ছবিতে কার্যত একই ধরনের চরিত্রে অভিনয় করেছেন। আবার, সেই ছাঁচ কী ভাবে যোগ্য পরিচালকের হাতে অসামান্য হয়ে উঠতে পারে, তার প্রমাণ ছিল একাধিক ফিল্মে। জলসাঘর, কাঞ্চনজঙ্ঘা, দেবী, কাবুলিওয়ালা...
মজা এই যে বাঙালি কিন্তু তাঁর কোনও অভিনয়ই ফেলতে পারল না। কঠোর পিতার ভূমিকায় তিনি পুত্র উত্তমকুমারকে প্রবল তিরস্কার করছেন। শেষে হয়তো ভুল বুঝতে পেরে অনুশোচনায় দগ্ধ। বাঙালি গলার কাছে দলা-পাকানো আবেগ নিয়ে দেখল সেই দৃশ্য। আবার, সেই কঠোর পিতাই যখন দেখা দেন সত্যজিৎ রায়ের ‘কাঞ্চনজঙ্ঘা’য়, যখন গম্ভীর জমিদার ‘জলসাঘর’-এ ছড়ি হাতে দেখিয়ে চলেন পূর্ব-পুরুষদের ছবি, তখন সেই অভিনয় সবাইকে শিহরিত করে।
এবং, পাগড়ি এবং জোব্বা পরে তিনি যখন ‘হিং চাই হিং’ বলে পর্দায় আসেন কাবুলিওয়ালার বেশে, একরত্তি মিনির সঙ্গে গড়ে ওঠে তাঁর অসমবয়সী সখ্য, আর ছবির শেষে যখন রবি ঠাকুরের সেই গল্পটি দেখায়, পিতৃহৃদয়ে কোথাও দেশভাগের কাঁটাতার নেই, তখন সেই বোধ একেবারে স-শরীরে জেগে ওঠে আমাদের সামনে। কান্নাহাসির দোলে আকুল বাঙালি সেই আফগান পুরুষের বেশধারী বাঙালি অভিনেতাটিকে আপন করে নেয়।
আবার, ছবি বিশ্বাস-এর আরও একটি বৈশিষ্ট্য এই যে তিনি আদ্যন্ত নাগরিক, অর্থাৎ ‘আর্বান’। পঞ্চাশের দশকে শহর কলকাতায় বিলিতি কেতাদুরস্ত বঙ্গীয় অভিজাতকুল কেমন ছিলেন, তার একটি নিখুঁত প্রতিচ্ছবি ছবি বিশ্বাস অভিনীত বিভিন্ন চরিত্র। একই সঙ্গে, ধুতি-পাঞ্জাবিতে তিনি অভিজাত বাঙালি। ফলে, একই শরীরে তিনি বহন করেছেন একটি বিলুপ্ত হয়ে-আসা সময়ের দু’রকম ছবি। তাঁর মৃত্যুর সময়, অর্থাৎ ১৯৬২ নাগাদ সেই ছবিটি বিলুপ্তপ্রায় ছিল। এখন তা কার্যত প্রত্নবস্তু, ইতিহাসের সামগ্রী। স্যুট-টাই এবং ধুতি-পাঞ্জাবি, দু’টি বেশেই তিনি ঔপনিবেশিক বাংলার একটি চেহারাকে ধরে রাখেন।
দেহ-পট সনে নট সকলই হারায়, ফলে তাঁর অকাল-মৃত্যুর পঞ্চাশতম বর্ষটি, প্রায় নিঃশব্দেই, পেরিয়ে গেল এই পক্ষে। বাষট্টি বছর বয়সে মৃত্যু কি অকালপ্রয়াণ? অর্ধশতাব্দী আগের হিসেবে বাষট্টি বছর প্রয়াণের যোগ্য বয়ঃক্রম কি না, সেই তর্ক তোলার কোনও অর্থ হয় না। এই শহরে এখনও তাঁর ছায়া। পঞ্চাশ বছর আগের দুর্ঘটনার রক্তের দাগ ঝাপসা হয়ে এসেছে। সময় ছবি বিশ্বাসকে গ্রাস করতে পারেনি। তিনি বেঁচে আছেন একটি কালপর্বের আকার হিসেবে।




অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.