ব্যাগ গুছিয়ে...
নামচি থেকে নামছি
পাহাড়ের পাকদণ্ডি ছেড়ে আবার সমতলে ফেরা। নামচিকে প্রায় পাঁচ হাজার ফুট পিছনে ফেলে এ বার নামছি। আর নামতে নামতেই যেন দুহাতে জড়িয়ে ধরছে পিছনে ফেলে আসা কয়েকটা দিনের স্মৃতি।
দক্ষিণ সিকিমের এই শহরের উদ্দেশ্যে শিলিগুড়ি থেকে ভাড়া গাড়িতে সেবক রোড ধরে খানিক এগোতেই সবুজ তার দু’হাত বাড়িয়ে দিল। এ পথেই পড়ে মহানন্দা অভয়ারণ্য। অচিরেই পাশে এসে পড়বে তিস্তা। কিছু জায়গায় চড়া পড়ে গেলেও অনেকটা জায়গা জুড়ে তিস্তা খরস্রোতা। ছোট-বড় বোল্ডারকে অতিক্রম করে নদী আপন বেগে...।
আর একটু এগোতেই দিগন্তরেখায় কী যেন একটা ঘন হয়ে উঠতে লাগল। কী ওটা? মেঘ? নাহ্! পাহাড়। চড়াইয়ে ওঠা শুরু হল। তারই সঙ্গে শুরু হল শৃঙ্খলাহীন অরণ্য। মানুষের রোপণ করা সাজানো বাগানের শৃঙ্খলা সেখানে নেই। কোথাও চিরহরিৎ তো কোথাও পর্ণমোচী, হঠাৎ ঘন সবুজের মাঝে আগুনরঙা কৃষ্ণচূড়া। শাখাপ্রশাখায় আকাশ ছেয়ে আছে। তার ওপরে পরজীবী লতানে গাছের স্তর সূর্যের আলোকে বেমালুম আটকে ফেলছে। টের পাওয়া যায়, তাপমাত্রা কমছে। জঙ্গলের নিজস্ব একটা শব্দ আছে, শোনা যায় একটানা। বুনো একটা গন্ধ আর ভেজা ভেজা ঠান্ডা পেরিয়ে এসে উপস্থিত। নামচি।
এখানে আকাশকে ছোঁয়ার চেষ্টা করতে হয় না। সে তার মেঘের হাত বাড়িয়ে আপনিই ছুঁয়ে যাবে। নামচির নাম সার্থক, আকাশছোঁয়া।
বাঁধানো সেন্ট্রাল পার্ক শহরের প্রাণকেন্দ্র। তারই চার পাশে গড়ে উঠেছে খাওয়া-থাকার নানা বন্দোবস্ত, পর্যটক-টানা নানা সামগ্রীর দোকান। ফুলগাছ, ফোয়ারা, অ্যাকোয়েরিয়মে সাজানো এই পার্কের বেঞ্চে বসে স্থানীয় জীবনযাত্রার টুকরো দৃশ্য দেখেই কাটিয়ে দেওয়া যায় অনেকটা সময়। হোটেলের জানলা খুলেই সামনে মেঘে ঢাকা পাহাড়। অখণ্ড অবসরের মধ্যেই আগামী দিনের জন্য অধৈর্য হয়ে ওঠা। এই অঞ্চলে যাতায়াতের মাধ্যম বলতে গাড়ি। অল্প কিছু বাসও চলে। তবে বেড়াতে এসে সারা দিনের জন্য গাড়ি নেওয়াই শ্রেয়। দ্রষ্টব্য জায়গাগুলি নামচি থেকে পাঁচ থেকে সাত কিমির মধ্যেই। প্রথমেই পড়বে রক গার্ডেন। পাকদণ্ডী পথ নেমে গিয়েছে পাহাড়ের পাদদেশের দিকে আর তারই সিঁড়ি বেয়ে নামতে নামতে দেখা যাবে পাহাড়ের গায়ে হরেক ফুলের বাহার। আকাশ পরিষ্কার থাকলে দেখা মিলতে পারে কাঞ্চনজঙ্ঘারও।
নামচির পথের সৌন্দর্যই হল ফুল। অযত্নে ফুটে আছে অপূর্ব সুন্দর নানা রঙের ফুল। তার মধ্যে যেমন আছে থোকা থোকা গোলাপ, জবা, বিভিন্ন ধরনের লিলি তেমনি আছে ফকফকে বা নীলকমলের মতো স্থানীয় বহু ফুল। বিভিন্ন ফুল গাছ দিয়ে ছবির মতো বাড়িগুলি সাজানো। ফুলের শোভা দেখতে দেখতে পৌঁছে যাওয়া সামদ্রুপসে হিল। যার আরেক নাম ‘উইশ ফুলফিলিং হিল’। স্বপ্নপূরণের সন্ধানে নানা রঙের পতাকা লাগানো পথ দিয়ে উঠতে হবে বেশ খানিকটা। বৌদ্ধ সন্ন্যাসী গুরু রিনপোচের আকাশচুম্বি মূর্তি ও তার নিচে সামদ্রুপসে মঠ। মঠের চাতালে দাঁড়িয়ে নামচির সৌন্দর্য? এককথায় স্বর্গীয়। ভিতরে শান্ত পবিত্র নীরবতা। নানা রঙের কাপড়ে তৈরি প্রেয়ার হুইল ঘুরিয়ে বলতে হয় মনের বাসনা। সিঁড়ি দিয়ে আরও উপরে উঠে এসে দাঁড়ানো যায় মূর্তির আসনপদ্মের তলায়। মূর্তির কারুকার্য ছাড়াও তার উচ্চতাই মুগ্ধ করে।
ফেরার পথে গাড়ির চালক দেখালেন সামনের পাহাড়চূড়ায় মহাদেবের জটা। এ বার ওই পাহাড়ে উঠতে হবে। কিন্তু কিছু বোঝাই যাবে না কখন এক পাহাড় থেকে অন্যটায় চলে এসেছি। এটাই তো পাহাড়ি পথের মজা। বর্তমানে নামচির সব থেকে বড় পর্যটনের কেন্দ্র সলোফক হিলে সদ্য গড়ে ওঠা চারধাম। পাহাড়ের মাথায় বিশাল চত্বর জুড়ে বদ্রিনাথ ধাম, জগন্নাথ ধাম, দ্বারকা ও রামেশ্বরম ধাম। আছে কেদারেশ্বর-সহ দ্বাদশ জ্যোতির্লিঙ্গ ও সাঁইনাথ মন্দিরও। প্রতিটি মন্দির ও মূর্তি মূল ধামের প্রতিরূপ, কেদারধাম ছাড়া। বিশাল শিবমূর্তির পাদদেশে কেদারেশ্বর মন্দির। উচ্চতায় কেদার-বদ্রির তুলনায় কম হলেও পাহাড়ের উপরে এই চারধাম অনেকটাই সেই পরিবেশ আনতে সক্ষম হয়েছে। মন্দির চত্বরের পরিকল্পনা দৃষ্টিনন্দন। কেদারনাথের ধ্যানমগ্ন মূর্তি, হাতে ছড়িয়ে থাকা রুদ্রাক্ষের মালা, বিশালাকৃতি নন্দী, ধূপ-ধুনোর গন্ধ। অপূর্ব অভিজ্ঞতা।
একই দিনে দেখে আসা যায় টেমি চা বাগান। অবশ্য নামচি থেকে গ্যাংটক যাওয়ায় পরিকল্পনা থাকলে সে পথেও দেখে নেওয়া যায়। সবুজ গালিচা মোড়া পাহাড়ে হাঠাৎ দু’একটি বক্খু (পোশাক) পরিহিতা স্থানীয় মেয়ে দ্রুত হাতে দু’টি পাতা একটি কুঁড়ি সংগ্রহ করে চলেছে পিঠের ঝুড়িতে। মাঝে মাঝে কিছু পাইন বা দেবদারু গাছ মেঘের চাদর মুড়ি দিয়ে যেন পাহারা দিচ্ছে ছোট্ট গাছগুলোকে।
ঘরে ফেরার পথেই পড়ল সাঁই মন্দির। সোনালি রঙের কারুকার্য করা মন্দিরটির চূড়ায় তখন বেলার রোদ। মুগ্ধ চোখ বিশ্বাস করতে চায় এটা স্বর্ণমন্দির। সাঁইমূর্তির মাথায় নীল আকাশ, চাঁদ, তারা, নানা দেবতা। তাঁর নানা অলৌকিক কীর্তির ছবিও ফুটে আছে শিল্পীর তুলিতে। ভিতরেও সোনালি কারুকার্য, কাঠের উপর। আশ্চর্য লাগে, সবই বাঙালি কারিগরদের কাজ।
ঘরে ফিরে গরম কফি ও পকোড়া সহযোগে পাহাড়ে অন্ধকার ঘনিয়ে আসতে দেখা। যে কোনও পাহাড়ি এলাকার মতো নামচিতেও সন্ধের পরে রাস্তায় লোকজন কম, গাড়িঘোড়াও বিশেষ চলে না। অন্ধকার পাহাড়ের গায়ে গায়ে বাড়িগুলির আলো যেন জোনাকির মতো।
নামচি এলে দেখে আসতেই হবে রাবাংলা। মিনিট পঁয়তাল্লিশের পথ। পথে পড়বে পাইনের বন। এ রাস্তায় মেঘ সঙ্গ ছাড়বে না। গাড়ি থামল এমন এক জায়গায় যেখানে একখণ্ড মেঘ আটকে আছে দু’পাহাড়ের মাঝে। ঠিক যেন ঘুড়ি। রাবাংলায় প্রধান দ্রষ্টব্য বুদ্ধ পার্ক। পাহাড় কেটে গড়ে উঠেছে মঠ ও তাকে ঘিরে সুপরিকল্পিত পার্ক। মঠের মাথায় আকাশ আর তুলো-মেঘের প্রেক্ষাপটে করজোড়ে গৌতম বুদ্ধের বিশাল মূর্তি। তাঁর ধ্যানমগ্ন বিনম্র মূর্তির কাছে আকাশ যেন বিনয়ী হয়ে নেমে এসেছে। নামচি থেকে গ্যাংটক ছাড়াও ঘুরে আসা যেতে পারে পেলিং, নাথুলা পাস বা ছাংগু লেক।
আকাশ ছুঁয়ে থাকার দিন ফুরিয়ে আসে। নামচি মন মুড়ে দিয়েছে সবুজ সজীবতায়। দু’চোখে ভরে দিয়েছে আকাশ। নামচি সুন্দর। নামচিতে থাকার অভিজ্ঞতা আরও সুন্দর।

কী ভাবে যাবেন
যে কোনও ট্রেনে নিউ জলপাইগুড়ি। সেখান থেকে অটো, বাস বা গাড়িতে শিলিগুড়ি।
এখান থেকেও নামচির গাড়ি রিজার্ভ করা যায়। তবে তাতে খরচ পড়বে বেশি।
শিলিগুড়ি থেকে নামচি যাওয়ার বাস ও শেয়ারের গাড়ি দুইই পাওয়া যায়।
কোথায় থাকবেন
নামচির সেন্ট্রাল পার্কের আশেপাশে বেশ কয়েকটি বেসরকারি হোটেল আছে।
রিসর্ট আছে একটিই। আগে থেকে বুকিং থাকলে ভাল।




অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.