কথা আটকে যায়। চলতে হয় থমকে থমকে। লিখতে গেলে হাত সরতে চায় না। কিন্তু এই সব শারীরিক প্রতিবন্ধকতাকে হার মানিয়ে পড়াশোনায় এগিয়ে চলেছে নীতীশ মল্লিক। বাদুড়িয়ার পিয়ারা তেঘরিয়া হাইস্কুল থেকে এ বছর উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষা দিয়ে সে চারটি বিষয়ে লেটার-সহ ৪৩২ নম্বর পেয়েছে।
বাবা অসীম মল্লিক পেশায় চাষি। অসীমবাবু ও তাঁর স্ত্রী রেবাদেবী জানালেন, ১৮ দিন বয়সে জন্ডিসে আক্রান্ত হয় ছেলে। এরপরই ধীরে ধীরে শারীরিক প্রতিবন্ধী হয়ে পড়ে। কিন্তু দমে যায়নি। নীতীশ বলে, “যখন থেকে বুঝতে পারি আর পাঁচ জনের মতো আমার পক্ষে স্বাভাবিক কাজ করা সম্ভব নয়, সে সময়ই ঠিক করি আমাকে মন দিয়ে পড়াশোনা করতে হবে।” অবসর পেলে রবীন্দ্রনাথের বই তার সঙ্গী, আর বার বার পড়তে ইচ্ছা করে রামায়ণ-মহাভারত। |
নীতীশ, মণিশঙ্কর ও মধুরিমা। —নিজস্ব চিত্র। |
স্বপ্ন দেখে শিক্ষক হয়ে গ্রামের গরিব ছেলেমেয়েদের শিক্ষিত করার। স্কুলের প্রধান শিক্ষক অনুপম দে বলেন, “ও অন্যদের কাছে দৃষ্টান্ত। শত অসুবিধা থাকলেও এক দিনের জন্যও স্কুলে আসা বন্ধ করেনি ছেলেটা। মনের জোর আর একাগ্রতা থাকলে যে শারীরিক অসুস্থতা কোনও বাধা নয় তা প্রমাণ করেছে নীতীশ।”
হাওড়া ডোমজুড়ের দেশপুর গ্রামের বাসিন্দা মধুরিমা ভট্টাচার্য তিনটে বিষয়ে লেটার-সহ ৩৯৬ নম্বর পেয়েছে এ বছর উচ্চ মাধ্যমিকে। রুদ্রপুর শিক্ষা সদন স্কুলের ছাত্রীটির ইচ্ছে ইংরেজি নিয়ে পড়ে শিক্ষকতা করার। কিন্তু আর্থিক অনটন তার স্বপ্নে বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে। তার বাবা শিশির ভট্টাচার্য একটি ছোট দোকানের কর্মচারী।
তিনি বলেন, “যৎসামান্য বেতনে সংসার চালাতেই হিমসিম খাই। মেয়ের পড়ার খরচ চালানো খুবই অসুবিধার।” মা বন্দনাদেবী মেয়ের পড়াশোনা চালানোর জন্য চুড়ি তৈরির কারখানায় কাজ নিয়েছেন। কিন্তু তাতেও খরচ সামলানো দায় হয়ে পড়েছে। মধুরিমা বলে, “শিক্ষকতা করার ইচ্ছে থাকায় ইংরেজি নিয়ে পড়ার কথা ভেবেছিলাম। কিন্তু বাবার আর্থিক সমস্যায় তা হয় তো আর হয়ে উঠবে না।”
হাওড়ার উলুবেড়িয়ার বীরশিবপুর গ্রামের বাসিন্দা মণিশঙ্কর গোঁড়া এ বছর জয়েন্টে ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে (তফসিলি) ২৯ ‘র্যাঙ্ক’ করেছে। বহু দিনের স্বপ্ন পূরণ হলেও এই ফল তার মুখের হাসি বেশিক্ষণ ধরে রাখতে পারেনি। উল্টে এখন দুশ্চিন্তায় জেরবার ছেলেটি। পড়া কী ভাবে এগিয়ে নিয়ে যাবে, তা ভেবে আকূল। আর্থিক অভাবই তার মূল কারণ। কয়েক দিন আগে গাছের গুঁড়ি পায়ে পড়ে গিয়ে তার বাবা জয়দেব গোঁড়া শয্যাশায়ী। এর আগে চাষের জমিতে কাজ করে সংসার চালাতেন তিনি। কিন্তু এখন তা আর না হওয়ায় মণিশঙ্করের টিউশনির টাকাতেই চলে সংসার। টাকার অভাবে কোনও দিনই কোনও গৃহশিক্ষকের কাছে পড়তে পারেনি সে। এ ভাবেই লড়াই চলেছে মণিশঙ্করের। |