বার্লিন বা মিউনিখের চেনা কোনও ফুটবল ভক্তের সঙ্গে দেখা হলে তাঁরা দাবি করেন, ‘জার্মানিই এখন নতুন নেদারল্যান্ডস’। মানে জার্মানদের ফুটবলেই এখন ডাচ ফুটবলের ছোঁয়া লেগেছে। ইউরোয় তার প্রমাণ দিয়ে গেলেন গোমেজ, সোয়াইনস্টাইগার, ওজিলরা।
ইউরোয় মাঠের চারধারে অসংখ্য বিজ্ঞাপনী বিলবোর্ডে একটা সময় ফুটে ওঠে ‘অরেঞ্জ’। আর অরেঞ্জ! বুধবারের ফুটবল যুদ্ধে আত্মসমর্পণ করে কমলা জার্সি ইউরো থেকে প্রায় মুছে যাওয়ার পথে। ক্রুয়েফ, মিশেলস, ফান গাল, রাইকার্ডদের মতো কোচদের দৌলতে স্পেনের ফুটবল মারাত্মক ভাবে প্রভাবিত হয়েছে ডাচদের হাতে। সেই ধারারই ‘তিকি-তাকা ফুটবল’ ইউরোতে অনুসরণ করছে অধিকাংশ দলগুলো। অথচ সুন্দর ফুটবলের ভগীরথরাই বিপন্ন। গত দুটো যুগের মতো এই টুনার্মেন্টেও ক্রুয়েফ, খুলিতদের উত্তরসূরিদের শূন্য হাত, মলিন মুখ।
এখনকার পাসিং ফুটবলে দু’ধরনের স্টাইলের কথা বলা হচ্ছে। একটা প্রো অ্যাকটিভ ফুটবলঅসংখ্য পাসে যেখানে বিপক্ষ বক্সে আক্রমণে ওঠার উদ্যোগ দেখানো হয়। অন্যটা রিঅ্যাকটিভ ফুটবলবিপক্ষকে একটা নির্দিষ্ট অঞ্চল পর্যন্ত খেলতে দেওয়া চলে। তার পরে পাল্টা প্রতিআক্রমণে। ডাচরা ছিলেন প্রো-অ্যাকটিভ ফুটবলে, জার্মানরা রিঅ্যাকটিভে। প্রথম ১ মিনিট ১০ সেকেন্ড ডাচদের অসংখ্য পাসের সমুদ্রে তাকিয়ে দেখল জার্মানরা। প্রথম দিকটায় ডাচদের পাসিং দেখে মনে হচ্ছিল, বিশ্বকাপ রানার্সদের পাসিং ঢেউ সমুদ্র হয়ে যাবে। অ্যালান শিয়ারার যা দেখে বলছিলেন, “বালক বনাম তরুণদের ফুটবল মনে হচ্ছে।” ‘বালক’ জার্মানরা দ্রুতই ফিরে এল নিজস্ব মহিমায়। ‘তরুণ’ ডাচরা ‘বালক’ হতে শুরু করল। |
ডাচ-জার্মানদের ম্যাচের উত্তেজনা এতটাই যে বিশ্বকাপে হেরে বার্তি ফোকসের সঙ্গে হাত মেলাননি জোহান ক্রুয়েফ, রাইকার্ড থুতু ছিটিয়েছিলেন রুডি ফোলারের মুখে। এখন রবেন, হান্টেলারের মতো তারকারা বুন্দেশলিগার অন্যতম স্টার। ডাচ তারকা ফান ডার ফার্ট ম্যাচের আগের দিন ছেলের গায়ে জার্মানির জার্সি পরিয়ে দিতে পারেন। কিন্তু ম্যাচটার দিন এখনও ডাচ গ্যালারিতে চিৎকার ওঠে, “আমার বাইক ফিরিয়ে দাও।” বিশ্ব যুদ্ধের সময় জার্মানরা সব ডাচ পরিবারের প্রিয় সাইকেল কেড়ে পুড়িয়ে অস্ত্র তৈরি করেছিল। সেই রাগ এখনও ভোলেনি ডাচরা। এ দিনও ডাচ গ্যালারি ওই গান গেয়েছে।
ম্যাচটায় অ্যাটাকিং থার্ডের উপর ফান পার্সির ব্যর্থতা দেখে মনে হচ্ছিল, তাঁর থিম সং হতে পারে, “আমার ক্লাবের ফর্ম ফিরিয়ে দাও”। ইংলিশ প্রিমিয়ার লিগের সেরা স্কোরারের রথের চাকা বসে যাচ্ছিল মোক্ষম জায়গায় এসে। পনেরো মিনিটের মধ্যে ফান পার্সির দুটো কল্পনাতীত সিটার নষ্ট। উল্টো দিকে মারিও গোমেজ দেখালেন, তিনি ক্লাব ফুটবলের ‘বাইক’ দেশের হয়েও হারাননি।
প্রথম গোলের সময় সোয়াইনস্টাইগারের থ্রু-পাসটা ধরেছিলেন নিজেদের গোলের দিকে মুখ করে। হঠাৎই টার্নিং করেই গোলের রাস্তা উন্মুক্ত করে দিলেন। ডাচ রক্ষণ চিরদিনই জানলা-দরজা হঠাৎ হঠাৎ খুলে দেয়। ওই টার্নিংয়ে গোলের দরজাটাও খুলে দিল। দ্বিতীয় গোলটার সময় কঠিন কোণে চলে গেছিলেন। সেখান থেকে কী দুর্দান্ত গোল! গোমেজ গত ইউরোয় পাঁচটা গোলে শট নিয়ে একটা গোলও পাননি। এখানে পাঁচটা শটে তিনটি গোল। গোমেজের জন্য স্পেনের কোচ ভিসেন্তে দেল বস্কি আক্ষেপ করতে পারেন। তাঁর বাবা স্প্যানিশ, মা জার্মান। দুটো দেশেরই নাগরিকত্ব ছিল। স্টুটগার্ট ও মিউনিখের মাঝামাঝি একটা গ্রামের ছেলে জার্মানির হয়েই খেলার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। তিনিই আপাতত ইউরোর সেরা স্ট্রাইকার।
জার্মান কোচ জোয়াকিম লো আসলে যুরগেন ক্লিন্সমানের ফুটবল-দর্শনের ভক্ত। ক্লিন্সমান যে দর্শনে দলটাকে চালাতেন, সেই নীতি নিয়েই এগোচ্ছেন। কী নীতি? বল পজেশন থাকলেই হবে না, তার সঙ্গে বল পজিশনটাও ঠিক রাখতে হবে। গত ছয় বছরে জার্মানরা যে প্রতিআক্রমণ ভিত্তিক ফুটবল থেকে পাসিং ফুটবলের হাত ধরেছে, তা ইয়োগি লো-র ভাবনারই ফসল। এ ম্যাচেও ১-০ এগিয়েও তাঁরা আক্রমণাত্মক নীতি থেকে সরলেন না। ধীরে ধীরে পাসের বুননে চাপ রেখে গেলেন ডাচ বক্সে। শুরুর দিকের ডাচ আধিপত্যের মধ্যেও ওজিলের শট পোস্টে লেগে ফিরল। গত বিশ্বকাপের পরে জার্মানরা হারিয়েছে ব্রাজিল, আর্জেন্তিনা, নেদারল্যান্ডস, ইংল্যান্ড, উরুগুয়েকে। পাঁচটা ম্যাচে তিনটের বেশি গোল রয়েছে। এই ম্যাচটা বুঝিয়ে গেল, কেন জার্মানরা আর এক গোলে সন্তুষ্ট হন না। এই ম্যাচ আর কী বোঝাল? ডাচরা বল পজেশন আর পজিশন ঠিক রাখার সমন্বয়টা ধরতে পারেনি। বক্স পর্যন্ত গিয়ে তারা শেষ। আমস্টারডামের ফুটবল পর্যবেক্ষকরা বলে থাকেন, ডাচ কোচ মারউইক গোঁয়ার। কিছুতেই তিনি ৪-২-৩-১ ছক থেকে সরবেন না। ক্রুয়েফ, খুলিটদের অনেকে বলেছিলেন, ফান পার্সির সঙ্গে হান্টেলারকে শুরু থেকে খেলাতে। ফান পার্সি মরসুমে ৩৭টি গোল করেছেন, হান্টেলার জার্মানিতে করেছেন ৪৮। জামাই ফান বোমেলকে বসিয়ে অনেক সৃষ্টিশীল ফান ডার ফার্টকে খেলানোর পরামর্শ ছিল ফান বাস্তেনের। ডাচ কোচ শোনেননি। বিরতিতে ০-২ পিছিয়ে তিনি হান্টেলার, ফান ডার ফার্টকে নামালেন। তখনই ফান পার্সিকে দেখে আর্সেনালের সমর্থকদের মতো মনে হচ্ছিল, “ইচ্ছে করলেই তাঁর গোল করা সম্ভব।” রবেন বা স্নাইডারের পায়ে বল পড়লেই বিপদের সঙ্কেত। ফান পার্সি ১-২ করার পরে ডাচরা আবার পুরনো ঝলসানি দেখাল। কিন্তু জার্মানরা যতই ‘নতুন নেদারল্যান্ডস’ হোক, তারা তো রক্ষণ করার শিক্ষাটা ভোলেনি! ডাচরাই ওই রক্ষণ করা এতদিনেও শিখল না! তাই বিপর্যয়, তাই শূন্য হাত, তাই মলিন মুখ! |