জঙ্গলের ভেতরে আগাছা ঢাকা অপরিসর পরিত্যক্ত খাল এখন পর্যটনের কেন্দ্রবিন্দু। পড়ন্ত বিকেলে এক সঙ্গে ডানা ঝাপটে উড়ে গেল বালিহাঁসের দল। সোনালি আলোয় মাখামাখি সেই দৃশ্য ক্যামেরাবন্দি করতে পর্যটকদের ছোটাছুটি। অলস দুপুরে মাছের আশায় বসে থাকে লালা মাথার হাঁস। জলাশয়ের পাশে কোথাও মদনটাকের দ্বিপ্রাহরিক ঝিমুনি। এমনই অসংখ্য দৃশ্যপট প্রতিদিন তৈরি হয় ডুয়ার্সের মরাঘাট জঙ্গলের গোঁসাইহাটে। একসময় ছিল নেহাতই একটি সরু খাল। শিলটং নামে একটি ঝোড়া থেকে তৈরি অপরিসর খালটি এতটাই জঙ্গলে ভরে থাকত যে মাছ ধরার জলও পাওয়া যেত না। তাই বনকর্মী থেকে স্থানীয় বাসিন্দা কেউ খালটিকে নিয়ে তেমন উৎসাহ দেখায়নি। অবহেলায় বয়ে চলা ঝোড়ার জল মেশা খালটি একটা নিচু জলায় গিয়ে শেষ হত। বছর পাঁচেক আগের কথা। এখন সেই খাল অন্তত পঞ্চাশটি প্রজাতির মাছে ভরা জলাশয়। শীতকালে সেখানে ভিড় জমায় পরিযায়ী পাখির দল। অধুনা বিরল মদনটা, ডাহুক, বালিহাঁস, সরাল, পান্ডুবির মতো স্থানীয় পাখিদের আস্তানাও ওই জলাশয়। যা দেখতে ভিড় উপচে পড়ছে পর্যটকরা। বন দফতরের পরিভাষায় পাখি-পর্যটনের অন্যতম কেন্দ্রবিন্দু গোঁসাইহাট। |
পাখি দেখার জন্য জলাশয়ের পাশে তৈরি করা হয়েছে নজর মিনার। রাত্রিবাসেরও ব্যবস্থা রয়েছে সেখানে। নজর মিনারের পাশে তৈরি করা হয়েছে একটি ইকো পার্ক। আছে বিনোদনের ব্যবস্থা এমনকী বনভোজনেরও।
সম্প্রতি বনমন্ত্রী হিতেন বর্মণ গোঁসাইহাটে একটি প্রকৃতিবীক্ষণ কেন্দ্রের উদ্বোধন করেন। বন দফতর সূত্রে জানা গিয়েছে, বছরে গড়ে অন্তত ১০ হাজার পর্যটক আসে এখানে। একটি খাল থেকে জলাশয় তৈরি এবং সেই জলাশয়কে কেন্দ্র করে পর্যটনকেন্দ্র গড়ে ওঠা বিরল ঘটনাই বটে। ২০০৬ সালে জলপাইগুড়ি বনদফতরের পক্ষ থেকে খালের মুখে বাঁধ দেওয়া হয়। স্বাভাবিক নিয়মে শিলটং ঝোড়া থেকে আসা জল আটকে আশেপাশে ছড়িয়ে পড়ে। এর পরে একটি বড় জলাশয় তৈরি করে বিভিন্ন প্রজাতির মাছ ছেড়ে দেওয়া হয়। পাঁচ বছরের মধ্যে সেখানে বাসা বাঁধে রকমারি পাখি।
সম্প্রতি বন দফতরের একটি সমীক্ষা রিপোর্টে জানা গিয়েছে, প্রায় ২৩ রকম প্রজাতির পাখি ওই জলাশয়ে দেখা যায়। বন দফতরের সমীক্ষার কাজে সহযোগিতা করে পরিবেশপ্রেমী সংগঠন ন্যাফ। সংগঠনের মুখপাত্র অনিমেষ বসু বলেন, “বছরের বিভিন্ন সময়ে গোঁসাইহাটে সমীক্ষা চালানো হয়েছে। শীতের মরশুমে পরিযায়ী পাখিরা দলবেঁধে সেখানে ভিড় করে। বছরের অন্য সময় জলাশয়টি স্থানীয় পাখিদের দখলে থাকে। মদনটাক, পরিযায়ী হাঁস, লাল মাথার হাঁস সহ রকমারি বিরল পাখির দেখা মেলে। শুধু পাখি কেন। নানা প্রজাতির মাছও রয়েছে জলাশয়ে।” বন দফতরের সমীক্ষায় জলাশয়ে ৩১টি প্রজাতির মাছের সন্ধান মিলেছে। যেমন, কাঁকসা, অঞ্জু, সরপুঁটি, নটওয়া, ল্যাটার মতো বিরল প্রজাতির মাছ। গোঁসাইহাটের বাসিন্দা মদন রাভা, নৃপেন রাভারা জানান, কিছুদিন আগেও ওই জলাশয় ছিল না। সেটা তৈরির পরে এলাকার ছবি পাল্টে গিয়েছে। এখন প্রচুর পর্যটক আসে। বন দফতর থেকে জলাশয়, নজরমিনার, পর্যটন কেন্দ্র দেখভালের ভার বনসুরক্ষা কমিটির উপরে দেওয়া হয়েছে। ফলে বাসিন্দাদের রোজগারের সমস্যা অনেকটা মিটেছে। গভীর জঙ্গলের ব্যাকড্রপে নজরমিনারে বসে পাখি দেখে একান্তে সময় কাটানোর পাশাপাশি জলাশয়ে বোটিং করাও পর্যটকদের কাছে অন্যতম আকর্ষণ। জলপাইগুড়ির ডিএফও কল্যাণ দাস বলেন, “আশাতীত ফল মিলেছে গোঁসাইহাটে। সঠিক পরিকল্পনা করে এগোলে যে এলাকার অর্থনীতি ঘুরে দাঁড়ায় গোঁসাইহাট তার প্রমাণ।” |