রাজ্য রাজনীতিতে বিমান বসু গুরুত্ব হারাইয়াছেন, কিন্তু তাঁহার প্রশ্নটি এখনও নির্বিকল্প শিল্প কি তবে হাওয়ায় হইবে? রাজ্যের বর্তমান শাসকরা যখন বিরোধী পক্ষে ছিলেন, তখনও তাঁহাদের নিকট এই প্রশ্নের জবাব ছিল না, দৃশ্যত এখনও নাই। সম্প্রতি রাজ্যের শিল্পমন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায় বিনিয়োগকারীদের সহিত একটি ‘মুক্ত আলোচনা’য় বসিলেন। সেই আলোচনাচক্রের পটভূমিতে এই প্রশ্নটি জ্বলজ্বল করিতেছিল। কিন্তু, উচ্চারিত হয় নাই। কারণ, সেই ‘মুক্ত আলোচনা’য় কোন প্রশ্ন করা চলিবে আর কোনটি করা চলিবে না, তাহা শিল্প মন্ত্রক পূর্বেই স্থির করিয়া দিয়াছিল। সরকার যে প্রশ্নের উত্তর এড়াইতে চাহে, কোনও বিচক্ষণ শিল্পপতি স্বভাবতই জনসমক্ষে সেই প্রশ্নটি করিবেন না। কিন্তু, তাহাতে প্রশ্নটি হারাইয়া যায় না। বস্তুত, শিল্পপতিরা নিজেদের মতো করিয়া এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজিয়া লইয়াছেন। সেই উত্তরটি পশ্চিমবঙ্গের পক্ষে ইতিবাচক নহে। এই ‘মুক্ত আলোচনা’য় আরও অনেকগুলি প্রশ্ন অনুচ্চারিত থাকিল। যেমন, শিল্পের প্রয়োজনে জমি অধিগ্রহণ না করিবার জেদটি কি রাজ্যের শিল্পায়নের সম্ভাবনার মূলে কুঠারাঘাত করিতেছে না? অথবা, বিতর্কিত ১৪ ওয়াই ধারা সম্পর্কে সরকার আদৌ কি কোনও সিদ্ধান্তে পৌঁছাইতে পারিবে? পারিলে, কবে? এই প্রশ্নগুলির উত্তরও শিল্পমহল নিজের মতো করিয়া জানে। কথাগুলি আলোচিত হইলে মন্ত্রী হয়তো বিনিয়োগকারীদের আশ্বস্ত করিতে পারিতেন। শ্রীচট্টোপাধ্যায়, এবং শ্রীবন্দ্যোপাধ্যায়, সেই সুযোগ হারাইলেন।
আলোচনাসভা যখন, তখন স্বভাবতই মন্ত্রিমহোদয় কিছু কথা বলিয়াছেন। যেমন, সরকারের জমি ব্যাঙ্ক তৈরি হইয়াছে ও উপযুক্ত শিল্প-প্রস্তাব পাইলে সরকার সেই জমি ব্যাঙ্ক হইতে জমির ব্যবস্থা করিবে। এই জমি ব্যাঙ্ক বিষয়টি আধুনিক পশ্চিমবঙ্গের বৃহত্তম অমীমাংসিত রহস্যের আখ্যা পাইতে পারে। মাঝেমধ্যেই শোনা যায়, ব্যাঙ্ক প্রস্তুত কিন্তু সেই ব্যাঙ্কের আমানতের কোনও ছবি অদ্যাবধি দেখা যায় নাই। জমি কোথায়, এক লপ্তে কত জমি সরকারের দখলে আছে, সেই জমির কত শতাংশ জঙ্গলমহলের ন্যায় বিপদসঙ্কুল জায়গায়, কত শতাংশ জমি কার্যত আধুনিক সভ্যতার সীমানার অপর পার্শ্বে আছে কোনও প্রশ্নেরই নির্দিষ্ট জবাব এখনও নাই। নাই বলিয়াই সন্দেহ হয়, জমি ব্যাঙ্ক বিষয়টি সম্ভবত ইয়েতি-সদৃশ। শিল্পমহলেরও এমন সংশয় নাই, তাহা হলফ করিয়া বলা মুশকিল। মন্ত্রিমহাশয় জমির বিকল্প ব্যবস্থার কথাও বলিয়াছেন রাজ্যে বিভিন্ন বন্ধ কলকারখানায় সাড়ে সাত হাজার একর জমি আছে। সরকার সেই জমিও নাকি দিতে পারে। এই প্রতিশ্রুতি সম্ভবত আইনে আটকাইয়া যাইবে। এবং, এই আইনটি রাজ্য সরকারের হাতে নাই, তাহা কেন্দ্রের বিবেচ্য। ইউ পি এ সরকারের উপর প্রবল দাপট থাকা সত্ত্বেও মুখ্যমন্ত্রী সেই আইনটি বদলাইবার বিষয়ে এখনও নীরব কেন, সে প্রশ্ন ভিন্ন, কিন্তু বর্তমান পরিস্থিতিতে বন্ধ কারখানার জমি দেওয়া সরকারের সাধ্যাতীত।
শ্রীচট্টোপাধ্যায় এই আলোচনাসভায় যাহা বলিয়াছেন, তাহার সারাৎসার পাঁচটি শব্দে প্রকাশ করা সম্ভব দল তাহার জেদ ছাড়িবে না। বেসরকারি উদ্যোগের জন্য সরকার জমি অধিগ্রহণ করিয়া দিবে না, তাহার সর্বাঙ্গে ‘জনস্বার্থ’ কথাটি লেখা থাকিলেও নয়। ইনফোসিস ফিরিয়া যাউক, সরকার বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল গড়িতে দিবে না। সরকারের এই সুর শ্রীচট্টোপাধ্যায় শুনাইয়াছেন বটে, কিন্তু ‘সকলি তোমারি ইচ্ছা’ গীতির প্রণেতা বলিয়া অভিহিত দেওয়ান রামদুলাল নন্দী থাকিলে বলিতেন পার্থ চট্টোপাধ্যায় যন্ত্রমাত্র, যন্ত্রী নহেন। সে যাহাই হউক, এই রাজ্যের বাস্তব হইল, সবার উপরে ইশ্তেহার সত্য, তাহার উপরে নাই। ফলে, শিল্প থাকুক অথবা যাউক, পশ্চিমবঙ্গ দেশের বিনিয়োগ মানচিত্রের বাহিরে চলিয়া যাউক ইশ্তেহারের কথা অক্ষরে অক্ষরে মানিয়া চলিতেই হইবে। বামপন্থীদের ঘাড়ে মার্কস-এর লেখা বোঝা ছিল। বর্তমান শাসকরা নিজেদের ইশ্তেহারের বোঝা বহিতে মনস্থ করিয়াছেন। এই বোঝা বহিবার জেদটি ত্যাগ না করিলে পশ্চিমবঙ্গ কোন অতলে তলাইয়া যাইবে, ভাবিতেও ভয় হয়। |