তিনি সুর দেখতে পেতেন।
মেহদি হাসানের সঙ্গে এক বার দেখা করতে গিয়েছিলেন আবিদা পারভিন। সুফি গায়িকাকে সে দিন ‘গজল সম্রাট’ বলেছিলেন, “আমি সুর দেখতে পাই।” পাঁচ দশকের সঙ্গীত-জীবনের শেষে আজ করাচির এক হাসপাতালে মারা গেলেন ‘সুরদ্রষ্টা’ মেহেদি হাসান। বয়স হয়েছিল ৮৪ বছর।
দীর্ঘদিন থেকেই অসুস্থ ছিলেন পাকিস্তানের এই শিল্পী। গত এক মাসে শরীর খুবই খারাপ হয়েছিল। অবস্থা গুরুতর হওয়ায় গত সোমবার তাঁকে হাসপাতালে ভর্তি করানো হয়। ফুসফুস, মূত্রনালী-সহ শিল্পীর শরীরের বিভিন্ন অঙ্গ-প্রত্যঙ্গে সমস্যা দেখা দিয়েছিল। করাচির ওই হাসপাতালের চিকিৎসকেরা জানাচ্ছেন, একে একে দেহের বিভিন্ন অঙ্গপ্রত্যঙ্গ কাজ বন্ধ করে দেওয়ায় মৃত্যু হয়েছে তাঁর। শিল্পীর পুত্র আরিফ হাসান বলেন, “আজ সাড়ে বারোটা নাগাদ বাবা মারা যান।” মৃত্যুর খবর প্রকাশ পেতেই হাসপাতালের বাইরে ভক্তদের ভিড় জমতে থাকে।
১৯২৭ সালে অবিভক্ত ভারতের রাজস্থানের লুনা গ্রামে জন্মেছিলেন মেহদি। বাড়িতে বহু প্রজন্ম ধরে গানের চর্চা ছিল। বাবা উস্তাদ আজম খান এবং কাকা উস্তাদ ইসমাইল খান ছিলেন রাজস্থানের কলওয়ান্ত ঘরানার ধ্রুপদ শিল্পী। তাঁদের কাছেই তালিম পান মেহদি। ’৪৭-এ দেশভাগের জোয়ার লাগে মেহদির পরিবারেও। তাঁরা চলে যান পাকিস্তানে। তখন মেহদি ২০ বছরের যুবক। |
শুরুর দিকে পাকিস্তানে রীতিমতো দারিদ্রের সঙ্গে লড়াই করতে হয়েছে মেহদির পরিবারকে। এক সময় তাঁকে স্থানীয় একটি সাইকেলের দোকানে কাজও নিতে হয়েছিল। কিন্তু, দারিদ্রের মধ্যেও দু’বেলা রেওয়াজ জারি রাখতেন। ১৯৫৭-য় প্রথম পাকিস্তানের রেডিওয় ডাক পান তিনি। এর পর আর ফিরে তাকাতে হয়নি।
যখন মেহদি পেশাগত ভাবে গান শুরু করেন, সে সময় উস্তাদ বরকত আলি খান, বেগম আখতার কিংবা মুকতার বাঈয়ের মতো শিল্পীরা মধ্যগগনে। মূলত উর্দু ভাষা এবং উর্দু কবিতার প্রতি আগ্রহ থেকেই মেহদি শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের পাশাপাশি গজল গানের প্রতিও আকৃষ্ট হন। ধীরে ধীরে মূলত গজল-শিল্পীই হয়ে ওঠেন তিনি। সুর এবং কাব্যের মেলবন্ধনই তাঁর গজলের অন্যতম বৈশিষ্ট্য ছিল। ফলে সেই সময়ের ‘তারকা সমাবেশেও’ নিজের স্বতন্ত্র জায়গা করে নিতে খুব বেশি সময় লাগেনি মেহদি হাসানের।
আশির দশক থেকেই শরীর ভাঙতে শুরু করে ‘গজল সম্রাটের’। কমে যেতে থাকে অনুষ্ঠানের সংখ্যা। অসুস্থতা সত্ত্বেও ২০০০-এ ভারত সফরে এসেছিলেন তিনি। সেই শেষ। সে সময়ই মুম্বইয়ে থাকাকলীন এক দিন গিয়েছিলেন লতা মঙ্গেশকরের বাড়িতে। স্মৃতি হাতড়াতে গিয়ে সে কথাই আজ বলছিলেন লতা।
|
শিল্পী স্মরণে |
সাক্ষাৎ ঈশ্বরের কণ্ঠস্বর! এমন সঙ্গীতজ্ঞ হাজার বছরেএক বার জন্মান।
এক মঞ্চে ওঁর সঙ্গে গাইতে না পারার আফসোস থেকে যাবে।
লতা মঙ্গেশকর |
|
|
|
সঙ্গীতের সঙ্গে যুক্ত প্রত্যেকে
ওঁর থেকে কিছু না কিছু শিখেছেন।
চিত্রা সিংহ |
|
ওঁর কাছে থেকে দীর্ঘদিন তালিম নিয়েছি। আমার কাছে
উনিই সত্যিকারের ‘তারকা’। দ্বিতীয় মেহদি হাসান আর হবে না।
তালাত আজিজ |
|
|
|
যে কণ্ঠস্বর বহু মানুষের হৃদয়ের কথা বলে দিত,
তা চিরদিনের মতো থেমে গেল।
শ্রেয়া ঘোষাল |
|
|
যাঁর গান সারা বিশ্ব শোনে, তিনি কেন শুনতেন মেহদি হাসানের গান? লতার কথায়, “সাক্ষাৎ ঈশ্বরের কণ্ঠস্বর। ওঁর মতো এক শিল্পী হাজার বছরে এক জন জন্মায়।” তাঁর আক্ষেপ, “এক মঞ্চে কখনও গান গাওয়া হয়নি আমাদের।” এক সঙ্গে একটিই মাত্র গান তাঁরা রেকর্ড করেছেন। আজ সে প্রসঙ্গও এল লতার কথায়। বললেন, ফারহাদ শাহজাদের লেখা ‘তেরা মিলনা’ গানে সুর দিয়েছিলেন মেহদি নিজেই। সেটা ২০০৯-এর কথা। তীব্র অসুস্থতার মধ্যেও নিজের অংশটুকু পাকিস্তানে তিনি রেকডির্ং করেন। ২০১০-এ মুম্বইয়ের একটি স্টুডিওয় ওই গানেরই তাঁর অংশটুকু রেকর্ড করেছিলেন লতা। দু’টি অংশ জুড়ে মুম্বই থেকে মূলত লতারই উদ্যোগে মেহদি হাসানের কাছে পাঠানো হয় তাঁদের সেই গান। লতা বলেন, “যখন গান ওঁর কাছে পৌঁছয়, তখন তিনি গুরুতর অসুস্থ। আমি শুনেছি, সেই গান শোনানো হলেও তখন তিনি তা বোঝার মতো অবস্থায় ছিলেন না।”
প্রয়াণের খবর জানার পর পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ইউসুফ রাজা গিলানি বলেন, “শুধু পাকিস্তানই নয়, শিল্পী ছুঁয়ে গিয়েছেন গোটা উপমহাদেশের মানুষের হৃদয়।” ভারতের প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংহ নয়াদিল্লিতে বলেন, “গানের মধ্যে দিয়ে জীবনভর সুফি ভাবাদর্শেরই প্রচার করেছেন এই পাক-শিল্পী।” পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এক শোক বার্তায় বলেন, “মেহেদি হাসানের মৃত্যুতে আমরা ভারত এবং পাকিস্তান দু’দেশের মধ্যে প্রকৃত সাংস্কৃতিক দূতকে হারালাম।” |