রাস্তার নাম শান্তিনিকেতন রোড। বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের বুক চিরে রাস্তাটি চলে গিয়েছে এক দিকে বোলপুর স্টেশন, উল্টো দিকে প্রান্তিক। এর মাঝে শ্রীনিকেতন থেকে কালীসায়র পর্যন্ত বিশ্বভারতীর বিশাল ক্যাম্পাস। এক সময় রাস্তাটি ছিল বিশ্বভারতীর এক্তিয়ারে। পরে তা হাত বদলে চলে যায় রাজ্য সরকারের পূর্ত দফতরের অধীনে। সে অনেক আগের কথা।
আপাতত এই রাস্তাকে ঘিরেই বিশ্বভারতীর ঐতিহ্য ও পরিবেশের সঙ্গে নগরায়নের দ্বন্দ্ব। আর তা শুরু হয়েছে এমন এক সময়ে, যখন সদ্য পূর্তি হয়েছে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জন্ম সার্ধশতবর্ষের।
বোলপুরে শান্তিনিকেতনের এলাকা কতটা? সঠিক কেউ জানেন না। তবে বিশ্বভারতীর সরকারি তথ্য মতে, এলাকাটা ১৪৯৯ একরের আশপাশে। রবীন্দ্রনাথের মুক্ত চিন্তাধারা ছড়িয়ে দিতে এই বিশাল সাম্রাজ্য কখনও সীমানা দিতে বেঁধে রাখা হয়নি। লালমাটির পথ, নদী আর গাছ-গাছালির হাত ধরে সে ছড়িয়ে পড়েছে গোড়াপত্তনের সময় থেকে। এখন সে সব ইতিহাস। আধুনিকতা ও নগরায়ন নামক জোড়া ফলার বাড়বাড়ন্তে ‘রবীন্দ্র তীর্থক্ষেত্র’-র পরিসর ১০০ একরেরও নীচে নেমে গিয়েছে, যার ইংরেজি পোশাকি নাম ‘বাফার বা হেরিটেজ জোন’। আশ্রমের চিন্তাধারা, ঐতিহ্য ও পরিবেশ ধরে রাখতে এই ‘বাফার জোন’কেই বাঁচাতে এ বার সক্রিয় হয়েছেন বিশ্বভারতী কর্তৃপক্ষ।
এই ‘বাফার’ বা ‘হেরিটেজ জোন’-এর মাঝে রাস্তার এক দিকে রয়েছে উদয়ন, মালঞ্চ, নাট্যঘর। উল্টো দিকে উপাসনা মন্দির, সঙ্গীত-কলা-পাঠভবন। পাঠভবনের কাছেই তৈরি হয়েছে গুরুপল্লি, সীমান্তপল্লিএখন যাবতীয় বিতর্কের কেন্দ্রবিন্দুতে যে দুই এলাকা বিরাজ করছে। বিশ্বভারতীয় উপাচার্য সুশান্ত দত্তগুপ্ত বলেন, “এক সময় বিশ্বভারতী চালানোর জন্য অর্থের অভাব মেটাতে পূর্বপল্লি ও রতনপল্লির জমি ‘লিজ’ দেওয়া হয়েছিল।” পরের কয়েক দশকে সেই লিজ জমি কত হাতে বেহাত হয়েছে, তার হিসাব নেই বিশ্বভারতীর কাছে। |
গুরুপল্লি ও সীমান্তপল্লি এখন পুরোদস্তুর অভিজাত এলাকা। সামনের সারিতে এক টুকরো বাগান-সহ ছিমছাম দোতলা বাড়ি সার দিয়ে রয়েছে। সবুজ মাঠের বুকে বহুতলের দাপাদাপি। শান্তিনিকেতনের অভিধানে ঢুকে পড়েছে ‘প্রোমোটার রাজ’।
কারা থাকেন এখানে? প্রায় সকলেই চেনা মুখ, বিশ্বভারতীর কর্মী-অফিসার-আধিকারিক। কেউ কেউ প্রাক্তন, অনেকে বর্তমান। বেশিরভাগ কৃষি ও জলা জমি ‘উন্নত’ করে প্লট আকারে বিক্রি হয়েছে। কিন্তু তাতেও চাহিদা না মেটায় ‘ফ্ল্যাট সংস্কৃতি’ ঢুকে পড়েছে নিঃশব্দে। গড়ে উঠেছে বহুতল। গুরুপল্লির প্রবীণ বাসিন্দা সৌরীন বন্দ্যোপাধ্যায় বলছিলেন, “এক সময় এই গুরুপল্লিতেই ক্ষিতিমোহন সেন, হরিচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়, সুখময় ভট্টাচার্যদের মতো পণ্ডিতদের খড়ের ঘর করে থাকার ব্যবস্থা ছিল। এঁরা ছিলেন ব্রহ্মচর্যাশ্রমের গুরুকুল।”
‘প্রোমোটার রাজ’-এর হাত ধরেই বিশ্বভারতীর আশপাশে লজ-হোটেল-মাল্টিপ্লেক্স-সাইবার কাফের বাড়বাড়ন্ত। স্থানীয় প্রবীণদের আক্ষেপ, বিশ্বভারতীর ‘বাফার জোন’ এখন কার্যত ইমারতের মিছিলে ‘বন্দি’।
এ ভাবে কংক্রিটের জঙ্গলে বিশ্বভারতীর ঐতিহ্য নষ্ট করা কি ঠিক? প্রশ্ন শুনে রেগে খেকিয়ে উঠলেন সীমান্তপল্লির যুবক। চাকরি করেন বিশ্বভারতীতেই। কিছুতেই নাম বলবেন না। তাঁর সাফ কথা, “দেশ এগোবে, আর বোলপুর কি পিছিয়ে থাকবে? বোলপুরের জনসংখ্যা বাড়ছে। তাঁদের থাকারও তো জায়গা চাই! কলকাতা-সহ দেশ-বিদেশের বাঙালিদের অনেকেই এখানে বাড়ি বা ফ্ল্যাট (অনেকের মতে, স্টেটাস সিম্বল) কিনে রেখেছেন।” যুবকের পাল্টা প্রশ্ন, “এই লোকগুলো থাকবে কোথায়? আকাশে?”
হক কথা। এ যুক্তি একেবারে ফেলে দেওয়ার নয়। অতএব জোরালো ভাবে প্রশ্নটা তুলছেন এলাকার অনেক বাসিন্দাই। এত লোক থাকবে কোথায়?
জনপদ তৈরি হলে অর্থনীতির নিয়ম মেনেই ফ্ল্যাট-বাজার-শপিং মল গড়ে উঠবে। অনেক স্থানীয় বাসিন্দার প্রশ্ন, বিশ্বভারতীর বহু জমি বেহাত হয়ে গিয়েছে ঠিকই। কিন্তু তার জন্য কর্তৃপক্ষ কেন কিছু করেননি? তাঁদের যুক্তি, বিশ্বভারতীর ‘বাফার জোন’-এ তো কেউ কিছু করছে না। যা হচ্ছে, তার আশপাশে। এটা বিশ্বভারতীর জমি নয়। এলাকার প্রোমোটার হাজি আফতার আলির দাবি, “সব আইন মেনে করেছি। বোলপুর পুরসভাকে জিজ্ঞাসা করুন। আমার প্লট তো বিশ্বভারতীর লোকেরাই কিনেছে!”
তবে কি ব্যাঙের ছাতার মতো গড়ে ওঠা ইমারতে বিশ্বভারতীর ঐহিহ্য হারিয়ে যাওয়াই ভবিতব্য? সে জন্যই বিভিন্ন মহলে দাবি উঠছে, এখনই উপযুক্ত ব্যবস্থা নিক প্রশাসন। ঐতিহ্য পুনরুদ্ধারে সক্রিয় হোন বিশ্বভারতী কতৃর্পক্ষ। আবার একটা মহলের মতে, মাথা গোঁজার জায়গা আর পরিষেবা ক্ষেত্রগুলো অটুট রেখেই ঐতিহ্য পুনরুদ্ধারের কাজ করতে হবে।
অতএব বিতর্ক থাকছেই। থাকছে দ্বন্দ্বও। ১১১ বছরের ঐতিহ্য ও পবিত্রতাকে কি গ্রাস করেই নেবে নগরায়ন? |