ভারত ও বাংলাদেশের ছিটমহল সমস্যা সমাধানে মনমোহন সিংহ সরকারের তৎপরতায় এ বার পাশে দাঁড়াচ্ছে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সরকারও।
তিস্তার জল বণ্টনের পাশাপাশি ছিটমহল হস্তান্তরের কাজটি শুরু হয়েও মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের আপত্তিতে আটকে গিয়েছিল। ভারতীয় ছিটমহলগুলি বাংলাদেশের মূল ভূখণ্ডে মিশে গেলে সেখানকার কিছু মানুষ পশ্চিমবঙ্গে চলে আসতে পারেন। প্রশাসনিক সূত্রের খবর, তাঁদের পূনর্বাসনের দায়ভার কে নেবে, তা নিয়েই মূলত প্রশ্ন তুলেছিলেন মুখ্যমন্ত্রী। কিন্তু সম্প্রতি একটি সমীক্ষায় দেখা গিয়েছে, ভারতীয় ছিটমহলের ৩৭ হাজার বাসিন্দার মধ্যে মাত্র ১৪৯টি পরিবারের ৭৪৩ জন ভারতের নাগরিকত্ব নিয়ে পশ্চিমবঙ্গে আসতে চান। বাংলাদেশের যে সব ছিটমহল ভারতের অঙ্গীভূত হবে, সেখানকার বাসিন্দারাই তাঁদের পুনর্বাসনের জন্য জমি নির্দিষ্ট করেছেন। কেন্দ্র এই বিষয়ে খবর নিয়ে রাজ্যকে আশ্বাস দেয়, পুনর্বাসন নিয়ে সমস্যা হবে না। প্রশাসনিক সূত্রের খবর, এর পরেই স্বাধীনতার পর থেকে জিইয়ে থাকা ছিটমহল সমস্যা মিটিয়ে ফেলতে কেন্দ্রের উদ্যোগে সামিল হয় রাজ্য সরকার।
ছিটমহল বিনিময়ের খুঁটিনাটি বিষয় আলোচনার জন্য এই প্রথম সোমবার মহাকরণে উচ্চ পর্যায়ের বৈঠকে বসছেন কেন্দ্র ও রাজ্য সরকারের সচিব পর্যায়ের অফিসারেরা। মহাকরণ ও জেলা প্রশাসন সূত্রে জানা গিয়েছে, কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র ও বিদেশ মন্ত্রকের প্রতিনিধিরা এই বৈঠকে যোগ দেবেন। রাজ্য প্রশাসনের তরফে থাকবেন মুখ্যসচিব ও স্বরাষ্ট্র সচিব। এ ছাড়াও ডেকে পাঠানো হয়েছে কোচবিহার ও জলপাইগুড়ির জেলাশাসককে। কোচবিহারের জেলাশাসক মোহন গাঁধী বলেন, “সোমবার কলকাতায় ছিটমহল সংক্রান্ত বৈঠকে উপস্থিত থাকার নির্দেশ পেয়েছি।” জলপাইগুড়ি জেলা প্রশাসনের এক কর্তা জানান, জেলার বেরুবাড়ি এবং লাগোয়া এলাকায় দুই দেশের জমি সংক্রান্ত কিছু সমস্যা আছে। বৈঠকে ওই বিষয় নিয়েও আলোচনা হতে পারে।
প্রশাসন সূত্রে জানা গিয়েছে, বাংলাদেশ ভূখণ্ডে রয়েছে ভারতের ১১১টি ছিটমহল এবং ভারতের মধ্যে বাংলাদেশের ৫১টি। এই ১৬২টি ছিটমহলের জনসংখ্যা, জীবিকা, অর্থনৈতিক অবস্থা সহ ছিটমহল বিনিময় হলে কত বাসিন্দা নিজেদের বাসস্থান বদলাতে চান ওই বিষয়ে তথ্য সংগ্রহের কাজ শুরু হয়েছে। এই পরিস্থিতিতে সোমবারের বৈঠকটি ছিটমহল সমস্যা নিরসনে একটি ইতিবাচক ও গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ। এই বৈঠকে ছিটমহল বিনিময় প্রক্রিয়া শুরুর রূপরেখা তৈরির ইঙ্গিতও মিলেছে।
জেলা প্রশাসনের এক পদস্থ কর্তা জানান, বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পরে ১৯৭৪-এ ইন্দিরা গাঁধী ও শেখ মুজিবর রহমানের মধ্যে হওয়া চুক্তিতে দু’দেশের মূল ভূখণ্ডে ছিটমহলগুলি মিলিয়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। অর্থাৎ বাংলাদেশের মধ্যে থাকা ১১১টি ভারতীয় ছিটমহল বাংলাদেশে এবং ভারতে থাকা ৫১টি বাংলাদেশি ছিটমহল ভারতে মিশে যাবে। কিন্তু বিভিন্ন কারণে এই চুক্তি রূপায়িত হয়নি।
দু’দেশের ছিটমহলের প্রায় ৫১ হাজার মানুষ সব ধরনের নাগরিক অধিকার থেকে বঞ্চিত হয়ে থাকেন। মনমোহন সরকার বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়নের পাশাপাশি ছিটমহল-সহ সব বকেয়া সমস্যা মিটিয়ে ফেলতে সক্রিয় হয়। গত বছর জানুয়ারি মাসে ঢাকায় দুই দেশের স্বরাষ্ট্রসচিব পর্যায়ের বৈঠকে ছিটমহলগুলি বিনিময়ের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। গত সেপ্টেম্বরে প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংহের ঢাকা সফরের সময় ইন্দিরা-মুজিব চুক্তি মেনে সমস্যা মেটাতে প্রোটোকলে স্বাক্ষর করেন দুই দেশের বিদেশমন্ত্রী। তার আগে গত জুলাই মাসে দুই দেশের যৌথ প্রতিনিধি দল ছিটমহলে জনগণনার কাজ সম্পূর্ণ করে। কিন্তু তার পরে মুখ্যমন্ত্রীর আপত্তিতে গোটা প্রক্রিয়া থমকে যায়।
‘ভারত-বাংলাদেশ ছিটমহাল বিনিময় সমন্বয় কমিটি’র সহকারি সম্পাদক দীপ্তিমান সেনগুপ্ত বলেন, “আমরা সমীক্ষায় দেখেছি ১৪৯টি পরিবারের ৭৪৩ জন বাসিন্দা বাংলাদেশের ভারতীয় ছিটমহলগুলি থেকে ভারতের মূল ভূখণ্ডে আসতে চান। মে মাসে বিষয়টি দুই দেশের সরকারকে জানিয়ে দেওয়া হয়েছে।” তিনি জানান, ওই সমস্ত পরিবারের বসবাসের জন্য কোচবিহার লাগোয়া বাংলাদেশি ছিটমহলের বাসিন্দারাই নিজেদের ৬২ একর বাস্তুজমি নির্দিষ্ট করেছেন। সরকার ওই পরিবারগুলিকে ভারতীয় নাগরিকত্বটুকু দিলেই আর কোনও সমস্যা হবে না। এ দিকে সোমবারের বৈঠক নিয়ে নতুন করে আশার আলো দেখতে শুরু করেছেন ছিটমহলের বাসিন্দারা। তাঁদের কয়েক জনের কথায়, “নাগরিকত্ব, রেশন কার্ড, ভোটার কার্ড কিছুই নেই আমাদের। নেই নিরাপত্তা। স্বাস্থ্য-শিক্ষা সহ অন্যান্য পরিষেবাও মেলে না। তাই ছিটমহলবাসীরা চান, যত দ্রুত সম্ভব এই সমস্যার সমাধান হোক।” |