কুর্নিশ মানুষকে |
‘লাল-গড়’ রক্ষায় সফল তমালিকা |
দেবমাল্য বাগচি • হলদিয়া |
স্বামী জেলে। দলেও অনেকটাই ‘কোণঠাসা’। পাশে ছিলেন না এক সময়ের সঙ্গীসাথীদের অনেকেই। ‘প্রবল প্রতিপক্ষে’র বিরুদ্ধে হলদিয়া পুরভোটে তমালিকা পণ্ডাশেঠের লড়াইটা ছিল অনেকটাই ‘একার লড়াই’। তবু মানুষেই আস্থা রেখেছিল লক্ষ্মণ শেঠের পত্নী। হলদিয়ার মানুষ তাঁকে বিমুখ করেননি। সেই ১৯৯৭-এ হলদিয়ার পুরসভা হয়ে ওঠার মুহূর্ত থেকে টানা ৪ বার জিতলেন তমালিকা।
মঙ্গলবার ভোটগণনা শুরুর সময় কিছুটা নিস্তরঙ্গই ছিল বাম শিবির। বোর্ড দখলের আশা করেননি অনেকেই। গণনা পর্ব এগোতেই দেখা যায় পূর্ব মেদিনীপুর ‘লাল-গড়’ লাল-ই থাকছে। উদ্বেল হয়ে ওঠেন তমালিকা পণ্ডাশেঠ। বলেন, “এই জয় মানুষের জয়। সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে শান্তির জয়।” একই সঙ্গে মনে করিয়ে দেন, “লক্ষ্মণ শেঠ জেল থাকলেও কতটা শক্তিশালী তার প্রমাণ মিলল। এটাই ঘুরে দাঁড়ানোর শুরু।” |
|
জয়ের পরে তমালিকা পণ্ডা শেঠ। ছবি: আরিফ ইকবাল খান। |
হলদিয়া পুরসভা দখল কার্যত ‘সম্মানের লড়াই’ ছিল তৃণমূল শিবিরের ‘প্রধান সেনাপতি’ শুভেন্দু অধিকারীর কাছে। নন্দীগ্রামের জেলায় পঞ্চায়েত, জেলা পরিষদ থেকে লোকসভা, বিধানসভায় বিপুল জয় পেলেও হলদিয়া পুরসভা তৃণমূলের অধরা থেকে গিয়েছিল। শুভেন্দু তাই এ বার মরিয়া চেষ্টা চালিয়েছিলেন হলদিয়া ‘দখলে’র। প্রচারে বারবার বলেছিলেন, “বিরোধী শূন্য হবে হলদিয়া।” ভোটের পরেও তিনি নিশ্চিত ছিলেন, “পরিবর্তনের বৃত্ত সম্পূর্ণ হবে।” লড়াই কঠিন ছিল জানতেন তমালিকাও। তবে হাল ছাড়েননি। হলদিয়ায় ভোট, অথচ লক্ষ্মণ শেঠ নেই। এটা মেনে নিতে কষ্ট হচ্ছিল তমালিকার। বারবারই বলেছেন, “ওঁর অভাব তো রয়েইছে।” তবে আবেগে ভেসে যাননি। লড়াইয়ের ময়দানে শক্ত থেকেছেন। ভরসা হারাননি মানুষের উপর থেকে। ভোটের দিনই তমালিকা বলেছিলেন, “মানুষ জেদের বশে ভোট দিচ্ছেন। ফলাফলেই তা দেখা যাবে।” তমালিকার বিশ্বাস বিফলে যায়নি। আর ভোটের ফল বেরনোর পরে এ দিন শুভেন্দু বলেছেন, “এটা পরাজয়, বিপর্যয় নয়।” পাশাপাশি হারের দায় স্বীকার করে যুব তৃণমূলের রাজ্য সভাপতির পদ থেকে অব্যাহতিও চেয়েছেন। |
জয়োল্লাস
|
পাঁশকুড়ায় তৃণমূলের জয়ের পর গণনাকেন্দ্রের বাইরে মন্ত্রী সৌমেন মহাপাত্র ( বাঁ দিকে)
ও তাঁর স্ত্রী সুমনাদেবী (ডান দিকে)-র সঙ্গে দলীয় কর্মীরা। ছবি: পার্থপ্রতিম দাস। |
২০০৯ সালের লোকসভা নির্বাচনে হার দিয়েই লক্ষ্মণ শেঠের ‘পতন’ শুরু হয়েছিল। ক্রমে দলেও কোণঠাসা হয়েছেন তিনি। সে নিয়ে কিছু অভিমান জানিয়ে ফেললেও আগাগোড়া ‘রেজিমেন্টেড পার্টি’র প্রতি অনুগত থেকেছেন লক্ষ্মণ-জায়া। তবে নন্দীগ্রাম নিখোঁজ কাণ্ডে গ্রেফতার হয়ে লক্ষ্মণ শেঠ জেলে যাওয়ার পরে মুখ খুলেছিলেন তমালিকা। সরব হয়েছিলেন ‘চক্রান্তে’র অভিযোগ তুলে। পুরভোটের প্রচারেও নন্দীগ্রাম প্রসঙ্গ, লক্ষ্মণ শেঠের হাতে নন্দীগ্রামের রক্ত লেগে থাকা, হলদিয়া পুরসভায় সিপিএম আর হলদিয়া উন্নয়ন পর্ষদে তৃণমূল ক্ষমতায় থাকায় কাজ করা সম্ভব নয় বলে সরব হয়েছেন শুভেন্দু। এ দিন জয়ের পর সেই কথা মনে করিয়ে দিয়ে তমালিকা বলেন, “উনি (লক্ষ্মণ শেঠ) কত খারাপ সে কথাই সবাই বলেছে। কিন্তু উনি যে হলদিয়ায় উন্নয়ন করেছেন, সে কথা বলেননি কেউ।”
তবু আস্থা ছিল মানুষে। সঙ্গে উদ্বেগ। সোমবার রাতে নিশ্চিন্ত ঘুমোতে পারেননি বলে জানালেন তমালিকা। এ দিন সকাল ছ’টায় বিছানা ছাড়ার পরই উদ্বেগ বাড়তে থাকে। লক্ষ্মণ-জায়ার কথায়, “উদ্বেগ তো ছিলই। তবে ১৪টি আসন পাওয়ার পর তা কেটে গিয়েছিল।” |
|
এগরায় বাম-মিছিল। ছবি: কৌশিক মিশ্র। |
সকাল দশটা নাগাদ দুই ছেলে সায়ন্তন, দীপ্তন ও বৌমা সুস্মিতাকে নিয়ে গণনাকেন্দ্রে এসে পৌঁছন তিনি। সুস্মিতাও বলেন, “এটা কঠিন লড়াই ছিল। শুধু মা নয়, দলের অন্যরাও জিতেছেন। খুব ভাল লাগছে।” সকলে আবির খেলাতেও মেতে ওঠেন। সবুজ পাড় লাল শাড়িতে তখন আবিরের ছোঁয়া। কপালেও আবির। তমালিকার মুখে হাসি। জয়ের হাসি। তবে সে হাসি খানিকটা ম্লান। কঠিন লড়াই জেতার দিনটিতেও যে পাশে নেই বহু লড়াইয়ের সঙ্গী সেই মানুষটি। |
|