|
|
|
|
লক্ষ্মণ-হীন হলদিয়ায় শুভেন্দুও না-পসন্দ |
দেবমাল্য বাগচি • হলদিয়া |
লক্ষ্মণ শেঠ জমানার ‘অপশাসনের’ স্মৃতি আবছা হয়নি। মঙ্গলবারের হলদিয়া পুর-শহর প্রমাণ করল অন্য কারও ‘অপশাসন’ও তার না-পসন্দ। লক্ষ্মণ শেঠ কারাবন্দি। সেই অবস্থাতেও হলদিয়া পুরসভা বামেদের দখলে। এলাকাবাসীদের একাংশ বলছেন, “এই কি পূর্ব মেদিনীপুরে অধিকারী সাম্রাজ্যের পতনের শুরু?”
দলের কারও সাহায্য চাননি। শুভেন্দু অধিকারী ভেবেছিলেন, একাই হলদিয়া দখল করবেন। তৃণমূলের অন্দরে দলনেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ‘সস্নেহে’ বলেছেন, শুভেন্দু ‘ছেলেমানুষ’। ভেবেছিলেন নিজেই পারবেন। পারেননি। ‘নন্দীগ্রাম-অস্ত্রে’ তৃণমূলকে একের পর এক ভোটে সাফল্য এনে দিয়েছেন শুভেন্দু। সেই ২০০৮ সালের পঞ্চায়েত থেকে। মঙ্গলবার তিনি কার্যত নিজের ভিটেতেই পরাভূত! বিপর্যয়? শুভেন্দু বলছেন, “বিপর্যয় নয়। পরাজয়। আমরা আলোচনা করে ফাঁকফোকরগুলো খুঁজে বার করার চেষ্টা করব।”
‘ফাঁকফোকর’ খুব একটা নেই। তৃণমূলের প্রথম সারির একাংশের মতে, হলদিয়ার হার খুব সরল ভাবে ব্যাখ্যা করা যায় হলদিয়ার জনগণ ‘দ্বিতীয় লক্ষ্মণ শেঠ’ চাননি। অথচ, রাজ্যে ‘পরিবর্তন’ এলেও হলদিয়ায় ‘বদল’ আসেনি। গত এক বছরে বারবার সেই অভিযোগ উঠেছে। দলের এক মন্ত্রী যখন শুভেন্দুকে অনুরোধ করেছেন, তাঁর পরিচিত এক ব্যবসায়ীকে ‘সাহায্য’ করতে, তখন তমলুকের সাংসদ জবাব দিয়েছেন, তা হলে বরং তাঁরাই কলকাতা থেকে এসে হলদিয়ায় দলটা চালান! কেন? সতীর্থ সাংসদের কথায়, “লক্ষ্মণের উপর তো সামান্য হলেও দলের একটা নজরদারি ছিল। শুভেন্দুর উপর তা-ও ছিল না। পূর্ব মেদিনীপুরের অধিকারী সাম্রাজ্য কালীঘাটের এলাকার বাইরে পড়ে তো!”
অথচ, হলদিয়ার সঙ্গেই পূর্ব মেদিনীপুরের পাঁশকুড়ার দায়িত্বেও ছিলেন শুভেন্দু। হলদিয়ায় তিনি হেরেছেন। পাঁশকুড়ায় কংগ্রেসকে নিশ্চিহ্ন করে দিয়ে, বামেদের পিছনে ফেলে বোর্ড দখল করেছে তৃণমূল। কিন্তু হলদিয়ার ‘ব্যর্থতা’র আড়ালে চাপা পড়ে গিয়েছে পাঁশকুড়ার ‘সাফল্য’। ২০০৮-পরবর্তী পর্যায়ে একের পর এক ‘জয়’ দেখেছেন শুভেন্দু। এই প্রথম তার ‘ব্যতিক্রম’ ঘটল। তা-ও হলদিয়ায়! |
|
|
জয়ের পর তমালিকা
পণ্ডা শেঠ। |
ফল জানার পর দুর্গাচকের সভায়
শুভেন্দু অধিকারী। |
|
বিধানসভা ভোটের ফলপ্রকাশের দিন থেকেই নব্য-শাসকদের ‘আস্ফালন’ দেখেছে হলদিয়া। সঙ্গে ‘রাজনৈতিক সন্ত্রাস’। সিপিএমের অভিযোগ, তাদের একের পর এক পার্টি-অফিসে হামলা, দখল চলছিল। সঙ্গে মারধর, জরিমানা আদায়। ‘সন্ত্রাসে’র সেই ধারা চলেছে পুরভোট-পর্ব জুড়েই। অভিযোগ করেছেন কংগ্রেসের প্রার্থীরাও। ভোটের দিন অবশ্য গুরুতর কোনও অভিযোগ ওঠেনি। বরং সিপিআইয়ের মহিলারা ‘নন্দীগ্রাম-মডেলে’ ঝাঁটা-হাতে তাড়া করেছিলেন গোলমাল পাকাতে-আসা তৃণমূল সমর্থকদের! ভোটদানের সুযোগে পুর-নাগরিকেরা ‘রায়’ জানিয়ে দিয়েছেন।
এর সলতে পাকানো হয়েছে গত এক বছর ধরেই। ভুক্তভোগীদের দাবি, শিল্প শহরের কারখানায়-কারখানায় তৃণমূলের একাধিক গোষ্ঠীর ‘কোন্দল’ দিনে দিনে বেড়েছে। স্থানীয় তৃণমূল নেতাদের একাংশ ঠিকা-শ্রমিকদের যে যার ক্ষমতা দেখাতে ব্যবহার করেছেন। তৃণমূলের ইউনিয়ন না-করলে ঠিকে কাজ মিলবে না এমন অলিখিত ‘নির্দেশ’ জারি হয়েছে। অথচ, হলদিয়া শিল্পাঞ্চলে ঠিকাদারি-রাজ শেষ করার প্রতিশ্রুতি দিয়েই ২০০৯-এ সাংসদ হয়েছিলেন শুভেন্দু। অভিযোগ, তাঁকেই উল্টে ঠিকাদার-রাজ চালাতে দেখেছেন শ্রমিক-কর্মচারীরা। বিভিন্ন কারখানায় তৃণমূলের একাধিক গোষ্ঠীর ‘তোলাবাজি, মাতব্বরি’ শিল্পদ্যোগীদের সঙ্কটে ফেলেছে। স্বয়ং শুভেন্দুর আপ্ত সহায়কের বিরুদ্ধেই ‘তোলা’ আদায়ের অভিযোগ ঘিরে শোরগোল উঠেছে। হলদিয়া পেট্রোকেমের ভবিষ্যৎ নিয়ে ‘সংশয়ের মেঘ’ অনুসারী অসংখ্য শিল্পের সঙ্গে যুক্ত শ্রমিকদের চিন্তায় ফেলেছে। |
|
হলদিয়ার গণনাকেন্দ্রের বাইরে পুলিশি পাহারা |
যার নিট ফল হলদিয়াকে ‘বিরোধী-শূন্য’ করার বাসনা নিয়ে বুক ফুলিয়ে ঘোরা শুভেন্দুর দিনের শেষে নতমুখ। যে হারকে সামনে রেখে বামেরা বলছেন, “পরিবর্তন-সূচনার জেলা পূর্ব মেদিনীপুর থেকেই পাল্টা পরিবর্তন শুরু হল!” লক্ষ্মণ-জায়া তমালিকা পণ্ডাশেঠ বলেছেন, “সন্ত্রাস ও প্রতিহিংসার রাজনীতির বিরুদ্ধে, শান্তির পক্ষে মানুষ রায় দিয়েছেন। আমাদের ঘুরে দাঁড়ানোরও এটাই শুরু। ওরা প্রচারেও লক্ষ্মণ শেঠকে ক্রমাগত আক্রমণ করেছে। জেলবন্দি লক্ষ্মণ শেঠও যে কতটা শক্তিশালী, ভোটের ফলে তা স্পষ্ট।” ফল প্রকাশের পর তমালিকাদেবীর গাড়ি ঘিরে তৃণমূল কর্মী-সমর্থকদের বিক্ষোভ, বিকেলে তমালিকারই পাড়া সুকান্তনগরে সিপিএম পার্টি-অফিসে ফের ‘হামলা’র রাজনীতি নগর-জীবনে উদ্বেগ বাড়িয়েছে। হলদিয়ার জনতা দেখেছে শাসকের অসহিষ্ণুতার রাজনীতি।
শুভেন্দু অবশ্য প্রকাশ্যে এখনও ডাকাবুকো, “একটা পুরভোটে জিতে যাঁরা আনন্দ করছেন, ক’টা দিন করে নিন। পঞ্চায়েত ভোটে তাঁদের খুঁজে পাওয়া যাবে না!” সন্ধ্যায় দুর্গাচকে প্রকাশ্য সভায় তিনি যুব-তৃণমূলের রাজ্য সভাপতির পদ থেকে ‘অব্যাহতি’ চেয়ে বলেন, “পঞ্চায়েত ভোটের আগে জেলায় বেশি সময় দিতে ওই পদ থেকে অব্যাহতি চাই।”
উপায় নেই। বেশি সময় দিতেই হবে। ‘অধিকারী সাম্রাজ্যে’ ভাঙনের সুর শোনা যাচ্ছে।
|
ছবি: আরিফ ইকবাল খান |
|
|
|
|
|