বিতর্ক...
অরাজনৈতিক ব্যক্তিই ভারতের উপযুক্ত রাষ্ট্রপতি
পক্ষে
নিরপেক্ষতা যখন প্রথম শর্ত
ভারতে গ্রেট ব্রিটেনের অনুকরণে সংসদীয় শাসনব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে। সেই শাসনব্যবস্থায় রাষ্ট্রপতির পদটিই অরাজনৈতিক। তিনি যদি জনগণের দ্বারা নির্বাচিত হতেন, তা হলে জনগণের দ্বারা নির্বাচিত মন্ত্রিসভা তথা প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে তাঁর ক্ষমতাগত বিরোধের সম্ভাবনা থাকত। এর ফলে, সংসদীয় ব্যবস্থাটিই বিপন্ন হত। তাঁর পদটি রাজনীতির ঊর্ধ্বে। জনগণ চায়, রাষ্ট্রপতি নিরপেক্ষ হোন। সংসদীয় ব্যবস্থায় দলীয় গরিষ্ঠতার স্বৈরাচারিতা রোধ করার জন্য এই রকম নিরপেক্ষ রাষ্ট্রপতি কাম্য।
কোনও রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব রাষ্ট্রপতি থাকাকালীন সরকার ও প্রধানমন্ত্রী পরিবর্তন হলে প্রায়শই সেই ভিন্ন রাজনৈতিক দলের বা ব্যক্তির সঙ্গে রাষ্ট্রপতিকে অনভিপ্রেত সংঘাতে জড়িয়ে পড়তে দেখা যায়। যার প্রত্যক্ষ প্রভাব দেশ ও আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে পড়তে পারে। যেমন রাজ্যপালের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীর বা মন্ত্রিসভার অন্য সদস্যদের মতানৈক্য ঘটলে রাজ্য রাজনীতিতে প্রবল আলোড়ন ওঠে।
আবার রাজনৈতিক বক্তিদের কিছু কিছু দলগত সীমাবদ্ধতা থাকতে বাধ্য। সেখানে অরাজনৈতিক ব্যক্তি অনেক খোলা মনে প্রকৃত জনহিতকর সিদ্ধান্তের মাধ্যমে রাষ্ট্রের স্বার্থের উপযুক্ত পথে দেশকে চালাতে পারেন। দলদাস হয়ে ভুল সিদ্ধান্তে দলের মঙ্গল হলেও দেশের, দশের সার্বিক ক্ষতির সম্ভাবনা থেকে যায় পূর্ণমাত্রায়। তাই রাষ্ট্রপতি পদের জন্য অরাজনৈতিক ব্যক্তিই উপযুক্ত।

স্বাধীন ভারতের প্রথম রাষ্ট্রপতি রাজেন্দ্রপ্রসাদের সঙ্গে প্রথম প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরুর মতের অমিল হওয়ার পরিপ্রেক্ষিতে তিনি সংসদে রুলিং চেয়েছিলেন। সে সময় ভারতের উপরাষ্ট্রপতি ছিলেন সর্বেপল্লি রাধাকৃষ্ণন। দর্শনতত্ত্বের মহা পণ্ডিত, অরাজনৈতিক, বলিষ্ঠ ব্যক্তিত্বসম্পন্ন মহান অতীন্দ্রিয়বাদী। ১৯৪৮ থেকে ১৯৫২ দীর্ঘ সময় তিনি সোভিয়েত ইউনিয়নে ভারতের রাষ্ট্রদূত হিসেবে কাজ করেছিলেন। স্ট্যালিন তাঁর ভারত প্রত্যাবর্তন কালে রাশিয়ার সম্পর্কে মতামত জানতে চাইলে রাধাকৃষ্ণন রাশিয়ার নাগরিকদের বহির্জগতে আত্মপ্রকাশের সুযোগ দেওয়ার আহ্বান জানিয়েছিলেন। ১৯৬২ সালে রাধাকৃষ্ণন ভারতের রাষ্ট্রপতি হিসাবে কার্যভার গ্রহণ করেন। তিনি কখনও রুলিং চাননি। কখনও কখনও মন্ত্রিসভার কাছে অসন্তোষ প্রকাশ করেছেন। চিন-ভারত যুদ্ধে পরাজয়ের জন্য নেহরুকে মৃদু ভর্ৎসনাও করেছিলেন। কিন্তু তার কোনও প্রকাশ ঘটেনি।
আর এক রাষ্ট্রপতির কথা প্রাসঙ্গিক। এ পি জে আব্দুল কালাম। তিনিও ছিলেন এক জন অরাজনৈতিক ব্যক্তি। তাঁর আমলেও কোনও অশান্তি দানা বেঁধে উঠতে পারেনি। অরাজনৈতিক কোনও পণ্ডিত ব্যক্তি, যিনি রাজনীতির নাড়ি-নক্ষত্র খুব ভাল করেই জানেন, এমন কাউকে রাষ্ট্রপতি করাই উচিত।

লোকসভা নির্বাচনে সংসদে কোনও দলই সংখ্যাগরিষ্ঠতা না পেলে অরাজনৈতিক রাষ্ট্রপতিই ঠিক সিদ্ধান্ত নিয়ে মন্ত্রিসভা গঠনে সদর্থক ভূমিকা পালন করতে পারবে।

বিপক্ষে
মাছ ছাড়াই মাছের পদ রান্না?
রাষ্ট্রপতি পদের নির্বাচনে প্রার্থী হতে গেলে মূলত যে পাঁচটি নিয়মের উপর জোর দেওয়া হয়, তার একটি হল কেন্দ্রীয় সরকার, রাজ্য সরকার বা স্থানীয় সরকারি কর্তৃপক্ষের কোনও লাভজনক পদে তিনি অধিষ্ঠিত থাকতে পারবেন না। কারণ, এ ক্ষেত্রে মনে করা হয়ে থাকে যে, সরকার পক্ষের লোক হলে সেই সরকারের প্রতি স্বভাবতই একটা মানসিক সমর্থন থেকে যাবে এবং সভা পরিচালনার সময় তা পক্ষপাতিত্ব সৃষ্টি করতে পারে। তবে এটা ভুলে গেলে চলবে না যে, রাষ্ট্রপতি সব সময় কোনও না কোনও রাজনৈতিক দলের জননির্বাচিত প্রতিনিধি দ্বারা সংখ্যাগরিষ্ঠ সমর্থন আদায়ে সক্ষম না-হলে তিনি এই পদে আসীন হতে পারেন না। এবং এই ক্ষেত্রে জনসাধারণের প্রত্যক্ষ কোনও ভূমিকা নেই।
তাই যদি দেশকে উন্নয়নের পথে নিয়ে যেতে হয়, গুরুত্বপূর্ণ বিল পাশে রাষ্ট্রপতির বিচারবুদ্ধির প্রশংসা করা হয় তা হলে অবশ্যই কোনও অভিজ্ঞ রাজনৈতিক ব্যক্তিকে ভারতের রাষ্ট্রপতি পদে নির্বাচিত করা উচিত। তিনিই একমাত্র ‘জাঁকজমকপূর্ণ সাক্ষীগোপাল’-এর অবস্থান থেকে বেরিয়ে এসে গুরুত্বপূর্ণ ও প্রয়োজনীয় বিভিন্ন সিদ্ধান্ত গ্রহণে সক্ষম হবেন।
সমাজে বসবাসকারী প্রত্যেকটি মানুষই প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ এই দুইয়ের মধ্যে কোনও না কোনও ভাবে রাজনীতিতে যুক্ত হতে বাধ্য। যেহেতু প্রত্যেক নাগরিকই কোনও না কোনও রাজনৈতিক দলকে ভোট দান করেন। তাই আমার মতে, কোনও শিক্ষিত সামাজিক দায়িত্ববান ব্যক্তিই অরাজনৈতিক হতে পারে না।
বিশ্বের বৃহত্তম গণতন্ত্র ভারতে অরাজনৈতিক ব্যক্তি সর্বোচ্চ পদাধিকারী হবেন এবং রাজনীতিমুক্ত হবেন এটা আশা করা যায় না। ভারতীয় সংবিধানের ৪২তম সংশোধনে বলা হয়েছে, রাষ্ট্রপতি ভারতের প্রধান শাসক, কিন্তু তিনি মন্ত্রী পরিষদের পরামর্শ মেনে চলতে বাধ্য। মন্ত্রী পরিষদ গঠিত হয় জনগণের প্রত্যক্ষ ভোটে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের নিয়ে। রাজনৈতিক দল যার প্রধান মাধ্যম। রাষ্ট্রপতি পদে প্রার্থীর মনোনয়ন পেতে অন্তত দশ ভাগ নির্বাচকের দ্বারা প্রস্তাবিত ও দশ জনের দ্বারা সমর্থিত হতে হবে।
সুতরাং, দেখা যাচ্ছে, প্রতি পদে রাষ্ট্রপতিকে রাজনৈতিক দলের উপর নির্ভর করতে হয়। এমনকী রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে পদ্ধতিও প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ ভাবে রাজনৈতিক প্রতিনিধিদের উপর নির্ভরশীল। তা হলে তিনি অরাজনৈতিক হবেন কী করে? বর্তমান রাষ্ট্রপতি প্রতিভা পাটিলও রাষ্ট্রপতি হওয়ার আগে নির্দিষ্ট রাজনৈতিক দলের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। রাষ্ট্রপতি কাগজে-কলমে অনেক ক্ষমতা ভোগ করলেও তা সবই মন্ত্রী পরিষদের অনুমোদনসাপেক্ষ। তাই সর্বোচ্চ প্রধান হয়ে শাসনকার্য চালাতে হলে তাঁকে রাজনৈতিক বাধ্যবাধকতা মেনে চলতেই হবে।
প্রতিটি রাজনৈতিক দলই নায়ক, গায়ক, লেখক, শিক্ষক, খেলোয়াড় ইত্যাদির মধ্যে ভোটপ্রার্থিপদ বিতরণ করছে। যৌবনকাল থেকে যাঁরা বিদ্যাচর্চার পাশাপাশি রাজনীতিটাও করে আসছেন, তাঁদেরই ভোটপ্রার্থী হওয়া উচিত। মনে রাখতে হবে, যত উন্নত মানের বীজই হোক না কেন, সব জমিতে সব ফসল লাভজনক হয় না। রাষ্ট্রপতি পদটা একশো শতাংশ রাজনৈতিক, অরাজনৈতিক ব্যক্তির প্রশ্নটা আসছে কী করে? এ তো মাছ ছাড়া মাছের পদ রান্না করার শামিল।

জুলাই মাসের বিতর্ক
আপনার চিঠি পক্ষে না বিপক্ষে, তা স্পষ্ট উল্লেখ করুন।
২৫ জুনের-র মধ্যে এই ঠিকানায়
জুলাই মাসের বিতর্ক,
সম্পাদকীয় বিভাগ,
আনন্দবাজার পত্রিকা,
৬ প্রফুল্ল সরকার স্ট্রিট,
কলকাতা-৭০০০০১


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.