|
|
|
|
প্রবন্ধ... যা দেখি, যা শুনি, একা একা কথা বলি |
|
যে সব প্রশ্নের কিছুতেই
উত্তর খুঁজে পাই না |
|
কাউকে দেখেই মনে হয় গ্রামের লোক। কেউ আবার ‘শিক্ষিত’, শহুরে।
অনেকের মুখ দেখেই মনে হয়, নির্ঘাত বাঙালি। কী ভাবে? উত্তর মেলে না। লিখছেন
সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় |
কয়েকটি ব্যাপারে আমার মনের মধ্যে খটকা রয়ে গেছে, কিছুতেই তার উত্তর খুঁজে পাই না। কোনও রকম যুক্তি দিয়েও তা মেলানো যায় না।
প্রথমেই ধরা যাক, এক জন শিক্ষিত মানুষ আর এক জন অশিক্ষিত মানুষের মুখের ভাব আলাদা হয় কেন? এখানে আমি শিক্ষার প্রয়োজনীয়তা কিংবা উপকার বিষয়ে প্রবন্ধ ফাঁদতে বসিনি, কিংবা প্রকৃত শিক্ষা কাকে বলে, কিংবা পুঁথিগত শিক্ষার চেয়েও যারা নিরক্ষর হলেও, যারা জীবন ও প্রকৃতি থেকে উচ্চাঙ্গের পাঠ নিতে সক্ষম, তাদেরও শিক্ষিত বলা যাবে কি না, এই সব গূঢ় প্রশ্ন তুলতে চাই না। খুবই সাদামাঠা ভাবে, যারা স্কুল-কলেজে মাঝারি ধরনের শিক্ষা পেয়েছে, তাদের তুলনায় যারা এই শিক্ষার সুযোগ পায়নি কিংবা নেয়নি, তাদের মুখভঙ্গির কেন তফাত হয়ে যায়, তা নিয়েই খটকা। পৃথিবীর অনেক দেশেই এখন এক জনও নিরক্ষর মানুষ খুঁজে পাওয়া দুষ্কর, কিন্তু আমাদের দেশে এ রকম মানুষের সংখ্যা বিপুল। তাদের দেখলেই আমরা বুঝতে পারি। দু’চারটে ক্ষেত্রে ভুল হতেই পারে, তা ব্যতিক্রম হিসেবেই গণ্য। কী ভাবে আমরা এটা বুঝতে পারি, তার কোনও যুক্তি আমরা খুঁজে পাই না। |
|
শহর ও গ্রাম। মৃণাল সেন-এর ছবি ‘আকালের সন্ধানে’-র একটি দৃশ্য। |
গ্রামের মানুষ আর শহুরে মানুষের মধ্যে এই তফাত? গ্রামের মানুষের মধ্যেই শিক্ষাহীনদের সংখ্যা বেশি, এটাও তো ঠিক। কিন্তু আজকাল গ্রামাঞ্চলে যেখানে শিক্ষার সুযোগ আছে, সেখানে অনেক ছেলেমেয়েই আগ্রহের সঙ্গে পড়তে যায়। কিশোরী মেয়েরা অল্পবয়সে বিয়ের বদলে লেখাপড়া চালিয়ে যাওয়ার আগ্রহ দেখাচ্ছে, প্রায়ই তো এ রকম শোনা যাচ্ছে। আবার, গ্রাম থেকে জীবিকার খোঁজে যে-সব নিরক্ষর মানুষ শহরে আসে, শহরেই বহু বছর থেকে যায়, স্কুল-টুলে যাওয়ার সুযোগ নিতে পারে না, তাদেরও তো শুধু শহুরে হওয়ার সুবাদেই মুখের ছাঁদ বদলায় না। আমি এ রকম দু’চার জনকে চিনি। আবার গ্রামে বসেই যাঁরা পড়াশোনা করেছেন, তাদেরও মুখের ছাপ বদলে যায়।
শিক্ষা মানুষকে কী দেয়? আত্মবিশ্বাস? না, আমি এটা মানতে রাজি নই। অনেক শিক্ষিত মানুষকেই দেখেছি, অস্থির ও দুর্বল চিত্ত। এদের অনেকেই জ্যোতিষীদের কাছে যায়। শিক্ষা মানুষকে বৃহত্তর জগৎসংসারের সঙ্গে পরিচয় ঘটিয়ে দেয় বলেই এ রকম পরিবর্তন ঘটে? ধনী কিংবা দরিদ্র, শহুরে বা গ্রাম্য, প্রত্যেক শিশুরই জন্মের পর কয়েক বছর মুখের ভাব একই রকম থাকে, তার পর তাদের মধ্যে যারা স্কুলে পড়তে যেতে শুরু করে, তাদের মুখের চামড়াও আস্তে আস্তে বদলে যায়, এটা কি বিশ্বাসযোগ্য? না!
ভাষা কিংবা ধর্ম বিশ্বাসের জন্যও কি মানুষের মুখচ্ছবি নানা রকম হতে পারে? শিশুদের কোনও ভাষা বা ধর্মবোধ থাকে না, সে সব আস্তে আস্তে অর্জন করতে হয়। সে জন্য তাদের পোশাক কিংবা ভাষারও পরিবর্তন হয়, কিংবা শারীরিক চিহ্ন, যেমন হিন্দুর মাথায় টিকি কিংবা মুসলমানদের গোঁফবিহীন দাড়ি। এখন অবশ্য অনেক ধর্মীয় মানুষের ওই সব চিহ্ন আর থাকে না, পোশাকও একই রকম, দূর থেকে তাদের মুখের ভাষা না শুনেও, শুধু দেখেই কী ভাবে বলা যাবে যে তারা কোন ধর্মের আশ্রিত? কোনও যুক্তি নেই, তবু এক-এক সময় বোঝা যায় কিন্তু।
টিভি’তে অন্য এক ভাষার ধারাবাহিক দেখতে দেখতে আমার স্ত্রী ওর নায়িকা সম্পর্কে বলেছিলেন, ওই মেয়েটাকে খুব বাঙালি-বাঙালি দেখতে!
এই বাঙালি-বাঙালি ব্যাপারটা কী? কিছু কাল আগেও বাঙালি হিন্দু রমণীদের শাড়ি পরার ধরন এবং ঘোমটা ছিল মুসলমান রমণীদের চেয়েও বেশ আলাদা, আর বাঙালি বাবুদের কোঁচা দোলানো ধুতি। কিন্তু এখন তো তা ঘুচে-মুচে গেছে, বিশেষ কোনও অনুষ্ঠান ছাড়া কাজের জীবনে হিন্দু ও মুসলমানদের পোশাকের তফাত থাকে না, তাদের মুখের ভাষা না-শুনেও দূর থেকে তাদের চিহ্নিত করার কোনও উপায় থাকে না, তবু মাঝে মাঝে চেনা যায়ও ঠিক।
এর মধ্যে চেক রিপাবলিকের প্রাগ (প্রাহা) শহরে বইমেলা উপলক্ষে ভারতীয় লেখকদের একটি প্রতিনিধি দলের অন্যতম সদস্য হিসেবে আমাকে যেতে হয়েছিল। কয়েকটি সেমিনারে দর্শক বা শ্রোতা খুবই কম। কারণ, কোনও ভারতীয় ভাষার বোঝার তো কোনও প্রশ্নই নেই, অনেকেই ইংরিজিও জানে না, দোভাষীর মাধ্যমেও জমে না। আমাদের দোভাষিনীর ইংরেজি জ্ঞানও বেশ কম। অনুষ্ঠানের মধ্যপথে চার-পাঁচ জনের একটি দল এসে পেছন দিকে বসল। এখন পৃথিবীর সব দেশেই কিছু না কিছু বাঙালি থাকে। এখানে এ পর্যন্ত কোনও বাঙালির সঙ্গেই যোগাযোগ হয়নি। ওই দলটির মধ্যে এক জন যুবককে দেখেই মনে হল, এ নিশ্চয়ই বাঙালি!
কী করে মনে হল? গায়ের রং দেখে বলা যায় যে সাহেব নয়, তবে ভারতের যে-কোনও রাজ্যের বা বাংলাদেশের বা পাকিস্তানের বা শ্রীলঙ্কার হতে পারে। সাধারণ প্যান্ট-শার্ট পরা। আলাদা কোনও রকম বৈশিষ্ট্যই নেই। নিজের মনকেই জিজ্ঞেস করলাম, তুমি কী করে ওকে বাঙালি ঠাওরালে? মন বলল, মনে তো হল। তার আমি কী করব? যুক্তিহীন বিশ্বাস আমি কোনও কালেই পছন্দ করি না, তাই নিজের মনের সঙ্গেই তর্কাতর্কি শুরু হল।
অনুষ্ঠানের শেষে সেই পাঁচ জন নারী-পুরুষের দল এগিয়ে এল মঞ্চের দিকে। যুবকটি আমার দিকে তাকিয়ে বলল, দাদা, আপনি...। সে শুধু নয়, পাঁচ জনই বাঙালি। যুবকটি বাংলাদেশি, তার নাম মামুন। সে এই শহরে একটা রেস্তোরাঁ চালায়। সেখানে আজ সন্ধেয় আমাদের আমন্ত্রণ।
তবু, কিছুতেই আমার খটকা মিটল না। কেন আমি তাকে বাঙালি বলে ধরে নিলাম? আগে থেকেই!
|
অতৃপ্তি এবং আগুন |
শুনেছি, না শুধু শুনিনি, কৃষ্ণনগরবাসী বিখ্যাত গবেষক সুধীর চক্রবর্তীর একটি লেখায় পড়েছি, অমিয়নাথ সান্যাল তাঁর বাড়ির উঠোনে তাঁর রচিত গ্রন্থের স্তূপে নিজেই আগুন লাগিয়ে দিয়েছিলেন। অমিয়নাথ সান্যাল আমার খুব প্রিয় লেখক, তাঁর একটি বই পড়েই আমি তাঁর ভক্ত হয়ে গিয়েছিলাম, যদিও তাঁর সঙ্গে সাক্ষাৎ হয়নি কখনও। বইটির নাম ‘স্মৃতির অতলে’। উচ্চাঙ্গ সংগীতের কয়েক জন অসাধারণ শিল্পী ও ব্যক্তিত্বকে নিয়ে এমন মর্মস্পর্শী রচনা বাংলায় আগে কখনও লেখা হয়নি। আমি নিজে এই বই কয়েকটি কিনে কিনে বন্ধুদের উপহার দিয়েছি। কোন ক্ষোভে, কোন মর্মযাতনায় তিনি সেই রচনা আগুনে পুড়িয়ে দিলেন, তা জানি না। অবশ্য অনুমান করা শক্ত নয়।
সম্প্রতি ‘চরাচর সারে’ নামে একটি বই আমার হাতে এল। এর শেষ মলাটে লেখা আছে যে, এই লেখক দিবাকর ভট্টাচার্য। তাঁর উত্তরাধিকারীদের স্পষ্ট নির্দেশ দিয়ে গিয়েছিলেন, তাঁর সমস্ত লেখাপত্তর যেন আগুনে পুড়িয়ে দেওয়া হয়। তাঁর ছেলে রঞ্জন ভট্টাচার্য একজন প্রতিষ্ঠিত চিকিৎসক, তিনি বাবার নির্দেশ মানেননি। বারোটি গল্প নিয়ে একটি সংগ্রহ প্রকাশিত হয়েছে সদ্য। বইটি একবার আদ্যোপান্ত পড়া শেষ করে আবার পড়তে ইচ্ছে হয়েছে আমার, এমনই অসাধারণ সেই সব রচনা। যেমন ভাষাঞ্জান, তেমনই চিন্তার গভীরতা। রামমোহন রায়, দ্বারকানাথ ঠাকুর, তাঁর স্ত্রী এই সব চরিত্র তিনি ফুটিয়ে তুলেছেন সম্পূর্ণ নতুন আঙ্গিকে।
তাঁর আসল নাম হরেরাম ভট্টাচার্য, জয়নগর মজিলপুরে জন্ম, উচ্চশিক্ষিত, সারা জীবনই প্রায় অধ্যাপনা করেছেন অর্থনীতিতে। ভাগ্যিস আগুন তাঁর রচনাগুলি ছুঁতে পারেনি! তাঁর অন্য রচনাও অবিলম্বে প্রকাশ হওয়া উচিত। |
|
|
|
|
|